বৃহস্পতিবার , ২৩শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

অর্থনীতি

চোরাচালানের লাখো গরু-মহিষ ‘বৈধ’ হয় গর্জনিয়া বাজারে!

সীমান্তবর্তী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি হয়ে কক্সবাজারের রামুর গর্জনিয়া বাজার।

মায়ানমার সীমান্তবর্তী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি হয়ে কক্সবাজারের রামুর গর্জনিয়া বাজারস্থ পশু বিক্রির হাটে বানের স্রোতের মতো প্রবেশ করছে চোরাচালানের গরু ও মহিষ। সাথে ডজনাধিক গরু-মহিষের খামার ব্যবহার হচ্ছে এসব চোরাচালানের পশু ‘বৈধ’ করণের কাজে। অনুসন্ধানে জানা যায়- খামারী পরিচয়ে এরা বেশিরভাগই গরু মহিষ ও মাদক সহ সীমান্ত পণ্য চোরাচালানের সাথে জড়িত।

“এ যেনো সীমান্ত বাণিজ্যের অঘোষিত চোরাচালান ট্রানজিটঘাট। অথচ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে সীমান্তের অপর আলোচিত বৈধ ট্রানজিটঘাট টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ করিডোর। ফলে কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে রাষ্ট্র। পক্ষান্তরে উক্ত রাজস্বের টাকা অবৈধপন্থায় ঢুকে যাচ্ছে বাজার সিন্ডিকেটের পকেটে।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত থেকে সাত কিলোমিটার দূরে রামুর কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের গর্জনিয়া বাজার। সেখান থেকে আধা কিলোমিটার এগিয়ে গেলে গর্জনিয়া পশু বিক্রির হাট। কোরবানীর ঈদে এই হাট বেশ জমজমাট থাকে। সর্বশেষ গেলো বাজারের দিন বড়, ছোট ও মাঝারি মিলিয়ে ২০০টির মতো গরু মহিষ উঠেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই মিয়ানমারের চোরাই গরু মহিষ। দেশীয় বলে এসব গরু বিক্রি হচ্ছে গর্জনিয়ার হাটে। এছাড়াও কোনো ধরণের বাজার ইজারা নীতিমালা উপেক্ষা করে চলছে এই বাজার। বাজারে টানানো হয়নি কোনো রেইট চার্ট। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে হাটে গিয়ে সরেজমিন এই চিত্র দেখা যায়।

সীমান্তের বিভিন্ন সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে- নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম সীমান্ত দিয়ে রাতের আঁধারে প্রতিদিন বাংলাদেশে ঢুকছে মিয়ানমারের শত শত গরু। সোনাইছড়ি, চাকঢালা, মৌলভী কাটা, হাজীর পাড়া, জামছড়ি, কেঁয়াজুর বিল এবং নাইক্ষ্যংছড়ি লেকের লাইটের গোড়া হয়ে কক্সবাজারের রামুর গর্জনিয়া বাজারে পৌঁছে যায় চোরাচালানের গরু মহিষ। চোরাচালানের আরও কিছু গরু-মহিষ বিক্রি হয় নাইক্ষ্যংছড়ি ডেইরি ফার্ম থেকে। এরপর এই গরু মহিষ বাজার থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ব্যবসায়ীরা কিনে নিচ্ছেন। 

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়- চোরাই গরু-মহিষের কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ডেইরি ফার্ম তথা খামারী পরিচয়ী কচ্চপিয়া হাজীপাড়ার নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী, গর্জনিয়া হাইস্কুল পাড়ার আমান উল্লাহ, জাফর আলম, হাজীর পাড়ার আবু ঈসা, বড়জামছড়ির আব্দুল্লাহ, ছুরুত আলী, শামসুল আলম, আব্দুল খালেক ও আব্দুস সালাম সহ আরও বেশ কয়েকজন। এদের মধ্যে নজরুল, আলী এবং আমান উল্লাহর ব্যাপারে বড় ধরণের মাদক পাচার ও বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য থেকে শুরু করে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ এবং গরু-মহিষের অবৈধ চোরাচালানের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।

মায়ানমার সীমান্তবর্তী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি দিয়ে আসছে গরু। ছবি: কক্সবাজার ট্রিবিউন

জানা যায়- এই অবৈধ গরু পাচারকে ঘিরে গত কয়েক মাসে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। বিজিবির সঙ্গে চোরা কারবারিদের গোলাগুলিতে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু চোরাচালান বন্ধ করতে পারছে না সরকারি সংস্থাগুলো। 

সীমান্ত ও স্থানীয় সূত্র বলছে- গত এপ্রিল থেকে আগষ্ট মাস পর্যন্ত সীমান্ত দিয়ে এপারে কয়েক লাখ চোরাই গরু ঢুকেছে। এপ্রিল মে মাসে ঢুকেছে ৭০ হাজারের বেশি। জুন মাসে ঢুকেছে ৫০ হাজারের বেশি গরু-মহিষ। আনুপাতিক হারে একইভাবে জুলাই এবং আগষ্ট মাসেও ঢুকেছে বানের স্রোতের মতো গরু মহিষ।

মিয়ানমার থেকে আসা এসব গরুর শরীরে সাংকেতিক চিহ্নের সিল মারা থাকে। গর্জনিয়া বাজারে তোলার আগে রাসায়নিক দিয়ে সেই সিল মুছে ফেলার চেষ্টা চলে। তারপরও কিছু গরুর গায়ে সিল থেকে যায়। মিয়ানমারের পাচারকারীরা গণনার সুবিধার্থে এই সিল লাগিয়ে দেয় বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। 

গত বৃহস্পতিবার গর্জনিয়া হাটে মায়ানমারের ১৩টি মাঝারি গরু বিক্রি করেন মৌলভী কাটার বাসিন্দা মো. ফরিদ। এসব গরু চোরাকারবারীদের কাছ থেকে কম দামে কিনে বাজারে বিক্রি করতে এসেছেন বলে জানান। চোরাই গরু বিক্রির কারণ জানতে চাইলে ফরিদ বলেন, গরু মিয়ানমারের হলেও তিনি বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে কিনেছেন। এছাড়াও যেভাবে সস্তায় চোরাচালানের গরু মিলছে এতে প্রকৃত খামারীরা গরু বাজারজাত করণ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।

গর্জনিয়া বাজার ইজারাদার (একাংশ) ইউপি সদস্য শাকিল প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন- এই বাজারে প্রায় সব গরু মহিষই মায়ানমারের। এগুলো চোরাচালানের মাধ্যমেই এসেছে। আর এখানে যেভাবে চোরাচালানের পশু সস্তায় পাওয়া যায় ফলে খামারীরা গরু উৎপাদন করার কোনো যৌক্তিকতাই থাকে না।

যোগাযোগ করা হলে কচ্ছপিয়ার ইউপি চেয়ারম্যান আবু নোমান জানান- চোরাচালানের গরু বাজারে ঢুকছে এটা সত্য। কিন্ত প্রশাসন যদি সীমান্তে চোরাচালান না ঠেকায় তাহলে এর দায় কে নিবে। স্থানীয় সাবেক এমপি কমলও বিষয়টি জানতেন বলে দাবী করেন এই ইউপি চেয়ারম্যান।

নাম প্রকাশ না করে একাধিক স্থানীয় নাগরিক জানান- রামু থানার গর্জনিয়া ফাঁড়ি, নাইক্ষ্যংছড়ি থানা এবং ইউএনও এসব গরু পাচারকারীদের নিকট হতে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে থাকেন। ফলে খামারীরা এখন পথে বসেছে এবং ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাধ্য হয়ে গরু মহিষ চোরাচালানের ব্যবসায় ঝুঁকেছে কেউ কেউ। তবে ইউপি চেয়ারম্যান আবু নোমানের ভাতিজা নজরুল এই অঞ্চলের শীর্ষ চোরাকারবারী এবং মাদক ব্যবসায়ী। তার নেতৃত্বেই এই সীমান্তে অবৈধ চোরাচালান বাণিজ্য নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গরুর পাল বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আনার পর দুর্গম সীমান্তের পাহাড়, জঙ্গল ও সামাজিক বনায়নের ভেতর জড়ো করা হয়। তারপর সময়–সুযোগ বুঝে ২০ থেকে ৫০টি গরুর পাল আনা হয় ঘুমধুম সীমান্তঘেঁষা চাকঢালা ও তুমব্রু টিভি টাওয়ার বাজারে। সেখান থেকে পাহাড়ি পথে গরু আনা হয় সাত কিলোমিটার দূরের কক্সবাজারের রামুর কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের গর্জনিয়া বাজারে। গর্জনিয়া বাজার থেকেই চোরাই গরু ছড়িয়ে পড়ে রামুতে। সেখান থেকে গরুগুলো ট্রাকযোগে পৌঁছানো হয় জেলার বিভিন্ন কোরবানির পশুর হাটে। কিছু গরু সরবরাহ করা হয় চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, লোহাগড়া, আনোয়ারা, বাঁশখালীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। 

অভিযোগ রয়েছে যে নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতা মূলত চোরাই গরু আনার ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন।  

রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার:

মাংসের সংকট নিরসন ও মিয়ানমার থেকে পশু আমদানির লক্ষ্যে ২০০২ সালে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে একটি করিডর চালু করা হয়। করিডর দিয়ে গরু আমদানি হলে সরকার রাজস্ব পায় ৫০০ টাকা। পশু আমদানির কারণে দেশীয় খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, এমন অজুহাতে ২০২১ সালের ৭ জুলাই করিডর দিয়ে পশু আমদানি বন্ধ করা হয়। তবে মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে পশু আসা বন্ধ হয়নি। টেকনাফের শুল্ক বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, করিডর চালুর ১৮ বছরে পশু আমদানির বিপরীতে সরকার ৩৬ কোটি ৮০ লাখ ৬৯ হাজার ৪০০ টাকা রাজস্ব আদায় করেছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে এক টাকাও আয় হয়নি। 

টেকনাফের ব্যবসায়ীরা বলেন- করিডর বন্ধের সুযোগ নিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে গরু পাচার শুরু হয়। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে এখন দৈনিক দুই হাজারের বেশি গরু ঢুকছে। করিডর চালু থাকলে সরকার রাজস্ব পেত। এব্যাপারে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অবহেলাকে দুষছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাস্টমস কর্মকর্তা।

বিপাকে খামারিরা:

কক্সবাজার শহরসহ জেলার ৯টি উপজেলায় গেলো কোরবানির ঈদে পশু বিক্রির হাট বসেছে ৯৪টি। সব কটি হাটেই চোরাই গরু বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে। কক্সবাজার সদরের খরুলিয়া, পিএমখালী, জুমছড়ি, রামুর কলঘর, মিঠাছড়ি ও টেকনাফের কয়েকটি বাজার সরেজমিন ঘুরে চোরাই গরু বিক্রি করতে দেখা গেছে। 

এভাবে চোরাই গরু বিক্রি হওয়ার কারণে কক্সবাজারের খামারিরা বিপাকে পড়েছেন। কচ্ছপিয়ার প্রসিদ্ধ খামারী রশিদ জানান- চোরাই গরুর কারণে তিনি ন্যায্য মূল্যে গরু বিক্রি করতে পারেননি। ফলে খামারে গরু পালন করে ব্যবসা করা তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। আগে এখানে ৫০/৬০ টি গরু ছিলো। এখন আছে মাত্র ৭টি।

এব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিভীষন কান্তি দাস জানান- গর্জনিয়া বাজার নিয়ে অনিয়ম স্বেচ্চাচারিতার অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে এবং প্রমাণ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও সীমান্তের চোরাচালান বন্ধে জেলা প্রশাসনের চেয়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) তৎপরতা বৃদ্ধির কথাও জানান তিনি।


সম্পর্কিত খবর