বৃহস্পতিবার , ২৩শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

চট্টগ্রাম

মিথের হ্রদ পেরিয়ে রূপকথার পাহাড় চূড়া

নাঈম খান :: রোমাঞ্চপ্রিয়দের কাছে কেওক্রাডং এক ভিন্ন আকর্ষণের নাম। শীতকালে বহু পর্যটক এই পাহাড় দেখতে ছুটে যান।  কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় উঠলে পাহাড় মেঘের মিতালি আপনাকে আন্দোলিত করবে মায়াবী আকর্ষণে। লিখেছেন নাঈম খান 

অনেক দিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ। কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে, তা জানি না। যদি তার দেখা পেতাম, দামের জন্য আটকা তো না।’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘পাহাড় চূড়ায়’ কবিতাটিতে যেন আমার মনের কথা বলে দিয়েছেন। পাহাড়ের নাম শুনলেই আমি হারিয়ে যাই অন্য জগতে। তাই এবারের গন্তব্য কেওক্রাডং, সেই সঙ্গে দেখা হবে বগালেক। সংক্ষেপে ক্রমান্বয়ে ভ্রমণকৃত জায়গাসমূহ : ঢাকা-বান্দরবান-রুমা-বগালেক-কেওক্রাডং-বগালেক-রুমা-সাঙ্গু নদ-রিজুক ঝরনা-রুমা-বান্দরবান-ঢাকা।

কেওক্রাডং শব্দটি মারমা ভাষা থেকে এসেছে। মারমা ভাষায় কেও মানে ‘পাথর’, কাড়া মানে ‘পাহাড়’ আর এবং ডং মানে ‘সবচেয়ে উঁচু’। অর্থাৎ কেওক্রাডং মানে সবচেয়ে উঁচু পাথরের পাহাড়।‘সবচেয়ে উঁচু পাথরের পাহাড়’খ্যাত, ৩২৩৫ ফুট উঁচুতে অবস্থিত বাংলাদেশের তৃতীয় (আনুষ্ঠানিকভাবে তৃতীয়, অনানুষ্ঠানিকভাবে পঞ্চম) পর্বতশৃঙ্গ ‘কেওক্রাডং’-এর উদ্দেশে আমরা যাত্রা শুরু করি ১২ ডিসেম্বর, রাত ১০টা ৪০ মিনিটে। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে বান্দরবান শহরে নেমে আমরা নাশতা সেরে আগের ঠিক করে রাখা চান্দের গাড়িতে রওনা করি কেওক্রাডংয়ের উদ্দেশে। তখন সকাল সাড়ে ৭টা। প্রতি চান্দের গাড়ি ভাড়া ১০ হাজার ৫০০ টাকা (সমিতি কর্তৃক নির্ণীত)। যেই গাড়ি আমাদের বান্দরবান শহর থেকে নিয়ে যাবে ‘বগালেক’। পরের দিন পুনরায় বগালেক থেকে নিয়ে আসবে বান্দরবান শহরে।

যাত্রাপথে এক চেকপোস্টে নাম এন্ট্রি করে আমরা পৌঁছাই ‘রুমা জোন’-এ। যেখানে সবার ব্যাগ চেক করা হয়। যেন সঙ্গে করে কেউ কোনো প্রকার অবৈধ জিনিস নিয়ে যেতে না পারে। ব্যাগ চেকের পরই সকাল ১০টায় আমরা পৌঁছে যাই রুমা উপজেলায়। যার দূরত্ব বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার। (বি. দ্র. : বান্দরবান শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে Y আকৃতির একটি রাস্তা অবস্থিত, সেই Y-এর একদিকে নীলগিরির পথ, আরেকদিকে রুমার পথ) রুমা পৌঁছেই আমরা সর্বপ্রথম দেখা করি আমাদের গাইডের সঙ্গে।

এরপর গাইডের কাছ থেকে অঙ্গীকারনামা সংগ্রহ করে, প্রত্যেককে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করে পুনরায় নাম এন্ট্রি করার জন্য উঠতে হয় ৫৮ সিঁড়ি ওপরে, ‘বাজারপাড়া আর্মি ক্যাম্প’-এ। এসব কাজ শেষ করে বেলা সাড়ে ১১টায় আমরা পুনরায় যাত্রা শুরু করি। দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে পৌঁছে যাই বগালেকে।বগালেক হ্রদ সৃষ্টি নিয়ে বম, মারমা, ম্রো, খুমি ও ত্রিপুরাদের পৌরাণিক কাহিনি বা কিংবদন্তি রয়েছে। এমন একটি পৌরাণিক কাহিনি হল বগাহ্রদের পাশে একটি বম পাড়া (বগামুখপাড়া) এবং একটি মুরং পাড়া আছে। স্থানীয় আদিবাসীরা বম, মুরং বা ম্রো, তঞ্চংগ্যা এবং ত্রিপুরাসহ অন্যান্য আদিবাসী। স্থানীয় আদিবাসীদের উপকথা অনুযায়ী, বগা শব্দটি নেওয়া হয়েছে ‘বাগা’ থেকে। বাগা অর্থ রাগান্বিত ড্রাগন। স্থানীয় আদিবাসীদের উপকথা অনুযায়ী, অনেক কাল আগে পাহাড়ের গুহায় একটি ড্রাগন বাস করতো। বম ভাষায় ড্রাগনকে বগা বলা হয়। ওখানকার গ্রামবাসীদের মতে, ড্রাগন-দেবতাকে তুষ্ট করতে স্থানীয়রা গবাদী পশু উৎসর্গ করতেন। কিন্তু একবার কয়েকজন এই ড্রাগন দেবতাকে হত্যা করলে চূঁড়াটি জলমগ্ন হ্রদে পরিণত হয় এবং গ্রামগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে।

যদিও এই উপকথার কোনো বাস্তব প্রমাণ নেই, তবুও উপকথার আগুন উদগীরণকারী ড্রাগন বা বগা এবং হ্রদের জ্বালামুখের মতো গঠন মৃত আগ্নেয়গিরির ধারণাটির সাথে মিলে যায়। অপর এক পৌরাণিক কাহিনীতে বলা হয়েছে বগা লেক ছিল একটি সমৃদ্ধ ম্রো গ্রাম। গ্রামের পাশে একটি সুড়ঙ্গে বড় আকারের সাপ থাকত। এক দিন ওই সাপ গ্রামবাসী ধরে খেয়ে ফেলে। ওই সাপ খাওয়ায় নাগরাজার প্রতিশোধের কারণে গ্রামবাসীসহ গ্রামটি দেবে গিয়ে বগা লেকের সৃষ্টি হয়। এখনো অনেক বম, ম্রোর বিশ্বাস, হ্রদের গভীরে থাকা নাগরাজ লেজ নাড়ালে হ্রদের পানি ঘোলাটে হয়ে ওঠে। বগালেকে পৌঁছেই লেকপাড়েই সামান্য উঁচু এক জায়গায় উঠে নাম এন্ট্রি করতে হয়। বগালেকে বেশকিছু কটেজ রয়েছে থাকার জন্য। প্রতিজন প্রতিরাত ১২০-১৫০ টাকা নেন তারা। আমরা বগালেকে রাত্রিযাপন করিনি।

বগালেকে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া শেষে কেওক্রাডংয়ের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে। এক কিলোমিটারের মতো পাকা রাস্তায় হাঁটার পর Y আকৃতির রাস্তা। একটি রাস্তা চলে যায় ‘স্যাংসং’পাড়ার দিকে। সেই রাস্তাটি পাকা আর অন্যটি মাটির। এই রাস্তা ধরে আমাদের যেতে হবে কেওক্রাডং। হাঁটার কিছুক্ষণ পর দেখা মিলল এক ছোট ঝরনাপ্রবাহের। কিছুক্ষণ হাঁটার পরই আবার দেখা মিলল আরেক ঝরনাপ্রবাহের, সেটির নাম ‘চিংড়ি’ ঝরনা এবং এটি দেখার জন্য কিছুটা ভেতরের দিকে হাঁটা লাগে। চূড়ায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে ভেবে আমরা বেশি দেরি না করে সেদিকে না গিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। এরপর অনেকটা ওপরে ওঠার পর পা যখন অবশের পথে আর তিন নম্বর পা বাঁশটাও ক্লান্ত, ঠিক সেই সময় আমরা পৌঁছে যাই লুনথংপাড়ায়। দেখলাম কজন মানুষ শরবত আর পেঁপের দোকান নিয়ে বসেছে।

১০ টাকার বিনিময়ে শরবত খেতে খেতে বান্দরবানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারার সৌভাগ্য যেন পেছনে ফেলে আসা প্রতিটি শারীরিক কষ্টকে কাটিয়ে পায়ে নতুন উদ্যম জোগায়। নতুন উদ্যমে হাঁটা শুরু করলাম আমরা, বিকাল ৪টা ১৫ মিনিটে হুট করেই চোখে দৃষ্টিগোচর হলো এক গোছানো পাড়া, দার্জিলিংপাড়ার। এরপর আর এক ঘণ্টা ট্র্যাকিং করেই আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের বহুল প্রতীক্ষিত পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডংয়ের চূড়ায়। তখন সময় ৫টা ১৫ মিনিট। কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় উঠে হেলিপ্যাড থেকে সূর্যাস্ত উপভোগ করার পর আর্মি অফিসে নাম এন্ট্রি করে আমরা আমাদের কটেজে চলে যাই। কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় থাকার জন্য চার-পাঁচটি কটেজ রয়েছে। কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় কনকনে শীতে হু হু বাতাসের মাঝে চাদর মুড়িয়ে আড্ডা দেওয়ার মুহূর্তগুলো যেন হাজারো গল্পের জন্ম দেয়। এভাবেই আমরা ক্লান্ত শরীরে পার করে দিলাম প্রথম রাত।

পাসিংপাড়া : কেওক্রাডংয়ের খুব কাছের জনবসতি এই পাসিংপাড়াকে বিবেচনা করা হয় দেশের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম হিসেবে। রুমা উপজেলা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে কেওক্রাডং পাহাড় অবিস্থত। যাত্রাপথ অত্যন্ত দুর্গম ও কষ্টসাধ্য বলে অনেকে বান্দরবান পর্যন্ত এসে ফিরে যান। দুর্গম এ পাহাড়ি এলাকার দৃশ্য খুবই মনোরম। বর্ষা মৌসুমে কেওক্রাডংয়ে যাতায়াত অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। কেওক্রাডংয়ের প্রায় ৩০৬৫ ফুট উচ্চতায় এই পাসিংপাড়া। বাংলাদেশের অন্য কোনো পাহাড়েও এত উঁচুতে কোনো জনবসতি নেই। প্রায় সারা বছরই মেঘের ভেতরেই থাকে এই পাসিংপাড়ার লোকজন। অপরূপ প্রকৃতি, পুরো পাসিংপাড়া ঢেকে থাকে মেঘে। আশপাশের সব চরাচর যেন একটা মেঘের সমুদ্র।

সূর্যোদয় দেখার জন্য আমরা উঠে পড়লাম অনেক ভোরে, সকালবেলার সৌন্দর্য্ উপভোগ করেই আমরা রওনা করলাম বগালেকের পথে, যেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে প্রথম দিনের সেই চান্দের গাড়ি। কেওক্রাডং ত্যাগ করার আগে আমাদের পুনরায় নাম এট্রি করতে হলো আর্মি অফিসে। সময় তখন সকাল ৭টা ৪৫ মিনিট। ৩০-৩৫ মিনিটের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম দার্জিলিংপাড়া। যেখানে আমরা সকালের নাশতা করব। নাশতা শেষে পুনরায় ট্র্যাকিং শুরু করলাম।

ট্র্যাকিংয়ের সময় মাঝপথে আখের এক দোকান দেখতে পাওয়া যায়। চিংড়ি ঝরনায় কিছু সময় কাটিয়ে অবশেষে আমরা বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে বগালেক পৌঁছাই। সেখানে খাওয়া-দাওয়া সেরে লেকপাড়ে কিছু সময় কাটিয়ে পুনরায় নাম এন্ট্রি করে আমরা আগের ঠিক করা চান্দের গাড়িতে রওনা দেই রুমার উদ্দেশে। সময় তখন ১২টা ৩০ মিনিট।

দুপুর দেড়টায় আমরা পৌঁছে যাই ‘মোএল্লাইপাড়ার ঘাট’-এ। যার অবস্থান বগালেক এবং রুমার মাঝখানেই। সেই ঘাটে আমরা নেমে পড়ি। গন্তব্য ‘রিজুক ঝরনা’। যেতে হবে মোটরচালিত নৌকায় করে সাঙ্গু নদ হয়ে। প্রতি নৌকায় ১০ জন উঠি আমরা। ২০-২৫ মিনিটে আমরা পৌঁছে যাই রিজুক ঝরনায়। রুমা ও থানচির মাঝেই রিজুক ঝরনার অবস্থান। রুমার এদিকে সাঙ্গু নদের সৌন্দর্য অপেক্ষা থানচির দিকের সাঙ্গু নদের সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর বেশি।

 

সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা অন্য আরেক ঘাটে চলে এলাম নৌকায় করে। যেখান থেকে রুমা থানার অবস্থান নিকটেই। সেখানে পুনরায় নাম এন্ট্রি করে চান্দের গাড়ি হয়ে আমরা ফিরলাম রুমা শহরে। সময় তখন দুপুর ৩টা। রুমা শহরের সেই ৫৮ সিঁড়ি ওপরের আর্মি ক্যাম্পে পুনরায় গিয়ে নাম এন্ট্রি করে আমরা বান্দরবান শহরের উদ্দেশে রওনা দেই।  সন্ধ্যা যখন ৬টা, তখন আমরা পৌঁছে যাই বান্দরবান শহরে। বান্দরবান শহরকে বিদায় জানিয়ে রওনা করি ব্যস্ততম শহর ঢাকার উদ্দেশে।


জেনে নিন
১. বান্দরবান পৌঁছানোর আগেই গাইড এবং চান্দের গাড়ি ঠিক করে নেওয়া উত্তম। এবং মানুষ বেশি হলে ঢাকা ফেরার টিকিটও আগে করে নেওয়াই উত্তম।
২. ২-৩ কপি জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা যে কোন পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখবেন। ।
৩. ট্র্যাকিংয়ের সুবিধার্থে রুমা থেকে ট্র্যাকিং সু কিনে নিতে পারেন।
৪. ট্র্যাকিংয়ের সুবিধার্থে বগালেকে ব্যাগের ওজন কিছু কমিয়ে রেখে যাওয়া উত্তম। গাইডকে বললেই সেই ব্যবস্থা করে দেবে।
৫. আগে থেকেই গাইডের সঙ্গে কথা বলে সব ধরনের খাওয়া-দাওয়া প্যাকেজ হিসেবে ঠিক করে রাখতে হবে।
৬. বগালেক হোক অথবা কেওক্রাডং হোক, থাকার ব্যবস্থা ও গাইডের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নিতে হবে।
৭.  মাঝপথে পানের জন্য ঝরনার পানি পাওয়া যায় দুই জায়গায়। এরপরও ব্যাগ ভারী হবে না এমন ওজনের পানি সঙ্গে নেওয়া উত্তম।
৮. প্রায় সব মৌসুমেই কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় হু হু ঠান্ডা বাতাস থাকে, তাই সঙ্গে শীতের কাপড় নেওয়া উত্তম।
৯. বগালেক থেকে কেওক্রাডং উঠতে সময় লাগবে মোটামুটি ৪ ঘণ্টা। রাস্তা পিচ্ছিল না থাকলে হাঁটা লাগবে প্রায় ১২-১৩ কিলোমিটার।
১০. ট্র্যাকিং পথের পুরোটাই গিরিপথ।
১১. চান্দের গাড়িতে করেও বগালেক থেকে কেওক্রাডং যেতে পারেন।
১২. ফেরার দিন এমনভাবে সময় হাতে নিয়ে ফিরতে হবে যেন রুমা জোনে বিকাল ৪টার মধ্যে পৌঁছানো যায়। দেরি হলে আর্মি চেকপোস্টে ঝামেলা পোহাতে হয়।


সম্পর্কিত খবর