বৃহস্পতিবার , ২৩শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

চট্টগ্রাম

প্রাণ ফিরছে চট্টগ্রামের বিপ্লব উদ্যানের

আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চট্টগ্রামের বিপ্লব উদ্যানে নির্মাণ করা বাণিজ্যিক স্থাপনা উপড়ে ফেলা হচ্ছে। এতে প্রাণ ফিরছে মহানগরের ষোলশহর দুই নম্বর গেটে নির্মিত উদ্যানটির। আগের তৈরি করা অবকাঠামো ভেঙে সবুজের উদ্যান করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

এর আগে ডা. শাহাদাত হোসেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিপ্লব উদ্যানকে সবুজ উদ্যানে রূপান্তরিত করার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের লোহার তৈরি অবকাঠামো ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ২০১৮ সালে নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া ২১টি দোকান ভাঙা হচ্ছে না। চট্টগ্রামের পরিবেশবিদদের দাবি, বিপ্লব উদ্যানের পূর্ব পাশে উত্তর-দক্ষিণ সারিতে তৈরি হওয়া ২১টি দোকান উচ্ছেদ করে উদ্যানের প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার। যদিও এর আগে ২১ দোকানের মালিকরা উদ্যানে নতুন করে আর কেউ যেন অবকাঠামো তৈরি করতে না পারেন সেটির জন্য আদালতে যান। আদালতের নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতার দাপটে নির্মাণকাজও অব্যাহত ছিল। এমনকি গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরও দ্রুত কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘রিফর্ম কনসোর্টিয়াম’।

এই উদ্যান থেকেই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। স্বাধীনতার স্বপক্ষে পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে বিপ্লবের ঘোষণা দিয়েছেন সেখান থেকে।  প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে স্থাপন করা ফলকে থাকা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নাম মুছে ফেলার চেষ্টা চালানো হয় বারবার। সবুজে ঢাকা ছোট্ট এই উদ্যানে আগ্রাসী আঁচড় পড়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়িত্ব পাওয়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রদের। ফলে দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছে লিজ দিয়ে উদ্যানকে ইটপাথরের জঞ্জালে পরিণত করা হয়েছে। তবে বর্তমান সিটি মেয়র বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেন ওই উদ্যানে আবারও প্রাণ ফেরানোর ঘোষণা দেওয়ার পর অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে।

গত বছরের আগস্টের শেষ সপ্তাহে বিপ্লব উদ্যানের সৌন্দর্যবর্ধন ও বিনিয়োগ নিয়ে রিফর্ম কনসোর্টিয়াম নামের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২৫ বছরের চুক্তি হয় চসিকের। এর আগে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর ২০ বছর মেয়াদি চুক্তি হয়েছিল রিফর্ম ও স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। পাঁচ বছরের মধ্যে পুরোনো চুক্তি সংশোধনের পর নতুনভাবে করা হয়। অবশ্য নতুন চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ায় স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস লিমিটেড। শুধু রিফর্ম কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি হয়। অন্যদিকে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করার কারণে ২০২০ সালের অক্টোবরে দোতলার স্থাপনা ভেঙে দিয়েছিলেন সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম। ওই সময় উদ্যানে স্থাপন করা আসনগুলোর একটি সারিও অপসারণ করা হয়। তবে নতুন চুক্তি অনুযায়ী, বিপ্লব উদ্যানে এখন থেকে স্থাপন করা যাবে বিলবোর্ড। আয়োজন করা যাবে মেলা বা উৎসব।

২০১৮ সালে সৌন্দর্যবর্ধনের দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠান দুটি উদ্যানের পূর্ব পাশে দোতলা ভবন নির্মাণ করেছিল। নিচতলায় ২১টি খাবারের দোকান করা হয়। ওপরে একই ধরনের দোকান করার কথা ছিল। রিফর্ম কনসোর্টিয়াম এ চুক্তির আড়ালে আরও দোকান তৈরি করে ভাড়া দেওয়ার চেষ্টা চালায়। পূর্ব পাশে উত্তর-দক্ষিণ সারিতে যে ২১টি দোকান রয়েছে এর সামনে পশ্চিম পাশে উত্তর-দক্ষিণ মুখোমুখি আরও ২১টি দোকান তৈরির জন্য লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে অবকাঠামো তৈরি করা হয়। এ কারণে আগের ব্যবসায়ীরা বারবার অভিযোগ করেন যে, হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে পরিবেশ ধ্বংস করছে চসিক। ঠিকাদার থেকে অবৈধ আর্থিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে পরিবেশ ধ্বংস করে স্থাপনা নির্মাণকাজ চলছে। এসব স্থাপনায় বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে ভাড়ায় দেওয়া হচ্ছে। সুবজ প্রকৃতি ধ্বংস করে মেলা ও সেমিনারের মাঠ বানানো হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত উদ্যানটিকে। এতে লেনদেন হয় কোটি কোটি টাকা।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, বিপ্লব উদ্যান থেকে ১০-১২ কোটি টাকা লোপাট করেছেন সাবেক মেয়ররা। স্থাপনা নির্মাণের নামে এ টাকা লুট করেছেন তারা। সাবেক প্রেসিডেন্ট মেজর জিয়াউর রহমানের নাম মুছে ফেলার জন্য স্থাপনা নির্মাণের কাজটি করেছিলেন তারা। তবে এবার আমি ঘোষণা দিয়েছি, বিপ্লব উদ্যানের প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এটিকে সবুজ উদ্যানে রূপান্তর করা হবে।

এদিকে বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, উদ্যানে লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে তৈরি করা কাঠামো এক্সকাভেটর দিয়ে তুলে ফেলা হচ্ছে। কংক্রিটের স্থাপনাও ভেঙে ফেলা হয়েছে। ট্রাকে তুলে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভাঙা অংশগুলো। তবে ২০১৮ সালে তৈরি করা দোকানগুলো ভাঙা হচ্ছে না। দোকানের সামনে তৈরি করা কংক্রিটের স্থাপনা বা দোকানের ক্রেতাদের বসার স্থান অক্ষত রয়েছে।

জানতে চাইলে পথচারী আলী আকবর বলেন, বিপ্লব উদ্যানে আগে সবুজের সমারোহ ছিল। উন্মুক্তভাবে হাঁটার ওয়াকওয়ে ছিল। বিকেলে সাধারণ মানুষ এসে হাঁটতে পারত, বসতে পারত। দোকান দিয়ে সেই পরিবেশ নষ্ট করা হয়েছে। শহরের মানুষ এখন হাঁটার জায়গাও পায় না। সব দোকান ভেঙে উদ্যানকে আগের মতো করা হোক।

বিপ্লব উদ্যানের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি হুমায়ূন কবির বলেন, ‘এই পার্কের নতুন স্থাপনা অপসারণ করে উদ্যানটিকে আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া আমাদের দাবি ছিল। এত দিন হাইকোর্টের রায় থাকার পরও সিটি করপোরেশন তা মানেনি। চট্টগ্রামবাসীর নাগরিক সুবিধার কথা চিন্তা করে এই পার্কটিকে আবার অবমুক্ত করা হোক।’

জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রিফর্ম কনসোর্টিয়ামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর্কিটেক্ট জয় আহমেদ বলেন, ‘এটা করার জন্য সাবেক মেয়রের সঙ্গে আমাদের চুক্তি রয়েছে। আমার তৈরি করা স্থাপনাগুলো কে বা কারা ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের জানা নেই।’


সম্পর্কিত খবর