বৃহস্পতিবার , ২৩শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

অর্থনীতি

নিলামে দেরি, পচল ৪ লাখ কেজি ফল

বছরজুড়েই আমদানি করা ফলের চড়া দাম থাকে বাজারে। অতিরিক্ত দামের কারণে সাধারণ ক্রেতারা কিনতে পারেন না এসব ফল। অথচ মার্কিন ডলারে বিদেশ থেকে আমদানি করা ফলমূল নষ্ট হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরে। চড়া দামে কেনা অন্তত ৭০ লাখ টাকার নষ্ট ফল ডাম্পিং করার উদ্যোগ নিয়েছে কাস্টম হাউস। সোমবার থেকে ডাম্পিং প্রক্রিয়ার কাজ শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব নষ্ট ফল ডাম্পিং করা হবে বলে জানিয়েছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। ক্রেতাদের প্রশ্ন, বিশেষায়িত রিফার কন্টেইনারে আমদানি করা ফল সহজে নষ্ট হয় না। ধ্বংসের আগেই নিলামে তুলে বাজারে বিক্রির সুযোগ ছিল। কন্টেইনারে পচে নষ্ট হওয়ায় দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা জরুরি।

কাস্টমস নিলাম ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়াকুব চৌধুরী বলেন, আমদানি করা ২১ কন্টেইনার ফলমূল নষ্ট হলো। কাস্টমস সময়মতো নিলাম আয়োজন করলে এত বিপুল পরিমাণ ফলমূল নষ্ট হতো না। যে হারে আমদানি ফলমূল নষ্ট হচ্ছে তাতে আমাদের মনে হয় কাস্টমস নষ্ট করতেই বেশি আগ্রহী।

কেন কাস্টমস কর্তৃপক্ষের নষ্টের আগে নিলামে তৎপর হয় না এ প্রশ্নে তিনি বলেন, এসব আমদানি ফলমূল বিশেষায়িত রিফার কন্টেইনারে রাখতে হয়। রিফার কন্টেইনারগুলো একেকটি রেফ্রিজারেটর। বন্দরের নির্ধারিত পয়েন্টে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে রাখতে হয়। আমদানিকারক যদি ৩০ দিনের মধ্যে খালাস না নেন সে ক্ষেত্রে দ্রুত নিলাম আয়োজন করতে হবে। তাতে নিলামকারীরা কম মূল্যে পণ্য কিনে বাজারে সরবরাহ করতে পারবেন। আবার মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি করা বিপুল ফলমূল ডাম্পিং করা থেকে রক্ষা পাবে। ডাম্পিং করা হলে কাস্টমস রাজস্ব পায় না। আবার বিদেশ থেকে আমদানি করা ফলমূল ক্রেতারাও পায় না। কারও লাভ না হলেও লাভ হয় দুর্নীতিবাজ চক্রের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নিলামকারী জানান, পচনশীল পণ্য রিফার কন্টেইনারে আমদানি করতে হয়। ফলমূল ছাড়াও আলু, আদা, পেঁয়াজ, খেজুরের মতো পণ্য আমদানি হয় রিফার কন্টেইনারে। আমদানিকারক চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পচনশীল পণ্যগুলো খালাস না করলে রিফার কন্টেইনারের সংকট দেখা দেয়। এতে বিদেশি বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরমুখী রিফার কন্টেইনার পেতে বেগ পেতে হয়। ডাম্পিং করা হলে কাস্টমস রাজস্ব না পেলেও দুর্নীতিবাজ চক্র লাভবান হয়। রিফার কন্টেইনারপিছু মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে দ্রুত নষ্ট পণ্য খালি করে শিপিং এজেন্টকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পরে এসব কন্টেইনার শিপিং এজেন্টরা চট্টগ্রাম বন্দরে আসা জাহাজগুলোর মাধ্যমে নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এ ক্ষেত্রে শিপিং এজেন্টদের লাভ হলো বিদেশি বন্দর থেকে রিফার কন্টেইনারে আমদানি পণ্যবোঝাই করা সহজ হয়। বিনিময়ে কাস্টমসের দুর্নীতিবাজ চক্র রিফার কন্টেইনার খালি করে আর্থিক সুবিধা লাভ করে।

চট্টগ্রাম নগরীর কদমতলী এলাকার ফলমন্ডির ফল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তৌহিদুল আলম বলেন, বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে বিদেশ থেকে আমদানি করা বিভিন্ন ধরনের ফল। আর ফলমন্ডির ৫-৬ কিলোমিটার দূরে হালিশহর এলাকার আনন্দ বাজারে ডাম্পিং ইয়ার্ডে নষ্ট ফল ধ্বংস করা হচ্ছে। বিষয়টি মেনে নেওয়ার মতো যুক্তি নেই। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সময়মতো নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নিলে মার্কিন ডলারে বিদেশ থেকে আমদানি করা ফল ধ্বংস করতে হতো না।

কাস্টমস সূত্র জানায়, ২১টি কন্টেইনারভর্তি ফলের মধ্যে আছে কমলা, মাল্টা, মান্দারিন (ছোট আকারের চাইনিজ কমলা) ও ড্রাগন ফল। আমদানিকারক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এসব ফলমূল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছাড় করেনি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ছাড় করার জন্য বিল অব এন্ট্রিও দাখিল করেনি। নিয়ম অনুযায়ী, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এসব পণ্য ছাড় করে নিতে আমদানিকারককে নোটিস দেয়। দশ দিনের মধ্যে এসব ফলমূল ছাড় না করায় নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নেয় কাস্টমস। কিন্তু নিলামে বিক্রির উদ্যোগ বন্দরে আমদানির ৫০ দিন পর নেওয়া হলেও ফলগুলো কন্টেইনারে অক্ষত থাকত। কিন্তু প্রায় তিন মাস পর নিলামের উদ্যোগ নেওয়ায় নষ্ট হয়ে গেছে। একাধিকবার নিলামে তোলা হলেও আগ্রহী ক্রেতা পাওয়া যায়নি। ৭০ লাখ টাকার প্রায় চার লাখ কেজি আমদানি ফল ধ্বংস করা ছাড়া এখন আর বিকল্প নেই।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার সাইদুল ইসলাম বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমদানি করা হয় কমলা, মাল্টা, মান্দারিন কমলা ও ড্রাগন ফল। আমদানিকারক বন্দর থেকে দীর্ঘদিন ছাড় করেনি। এ জন্য নিলামে বিক্রি করতে ব্যর্থ হওয়ায় ২১ রিফার কন্টেইনার ভর্তি ফল ডাম্পিং করে ধ্বংস করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলগুলোর মান ভালো না হওয়ায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কয়েকবার নিলামের আয়োজন করলেও প্রত্যাশিত দাম পাওয়া যায়নি।

নিলামে কেন বিক্রি হয়নি, এ প্রশ্নে নিলাম ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়াকুব চৌধুরী বলেন, আমরা নিলামে তোলার আগে সরেজমিন পণ্যের অবস্থা যাচাই করেছি। তাতে দেখেছি ৮০ ভাগ ফল কন্টেইনারেই নষ্ট হয়ে গেছে। এসব ফল নিলামে কি আমরা কিনতে পারি? নষ্ট ফলমূল বাজারজাত করলে উল্টো আমরা আইনি জটিলতায় পড়ব। এ ছাড়া নষ্ট ফলমূল নগদ টাকায় নিলামে কেউ তো কিনবে না। শেষ গন্তব্য হিসেবে এসব ডাম্পিং করতে হবে।

এদিকে সোমবার নগরীর ফলমন্ডি এলাকার পাইকারি আড়তসহ আশপাশের খুচরা ক্রেতাদের কাছে মূল্য যাচাই করে দেখা যায় ফলের দাম চড়া। ভরা মৌসুম হওয়ায় চাহিদাও বেশি। সেই তুলনায় সরবরাহ নেই। ফলমন্ডির আড়তে পাইকারিতে প্রতি কেজি মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ২৫০-২৮০ টাকা। মানভেদে প্রতি কেজি আপেল বিক্রি হচ্ছে ১৮০-২৫০ টাকা। আঙুর বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩০০-৩৩০ টাকা।

এসব ফলমূলের মধ্যে পাইকারি আর খুচরায় কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা তফাত। খুচরায় মাল্টা ও আপেল ৩৫০ থেকে ৩৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। আর আঙুর প্রতি কেজি দাম ৩৫০ টাকা থেকে ৩৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে মানভেদে।

নগরীর বহদ্দারহাট কাঁচা বাজারের সামনে ফলের পসরা নিয়ে নিয়মিত বসেন খুচরা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইরফান। তিনি বলেন, মানভেদে মাল্টা প্রতি কেজি ৩০০-৩২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। আপেলের অবস্থাও একই। নাশপাতি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩০০ টাকা। আঙুর ৩৫০ টাকা থেকে মানভেদে ৩৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এ মুহূর্তে চাহিদা অনুযায়ী বিদেশি ফলমূল পাওয়া যাচ্ছে। আড়ত থেকে সরবরাহে ঘাটতি হলে দাম আরও বাড়তে পারে।


সম্পর্কিত খবর