চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ড ও ফেনীর ফুলগাজী উপজেলাজুড়ে ৩৩ হাজার হেক্টর জমিতে তৈরি হচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ও ভূমি ধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকার পাশাপাশি ভূমিকম্প, খরা, নদী ভাঙনে এবং আকস্মিক বন্যার ক্ষেত্রেও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক অঞ্চল। পাশাপাশি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারণে ওই এলাকায় পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আঞ্চলিক পরিবেশ ও সামাজিক মূল্যায়নে (রোসা) এসব বিষয় উঠে এসছে। বুধবার (২০ নভেম্বর) রোসার খসড়া নিয়ে জাতীয় পর্যায়ের সেমিনারে বিভিন্ন ঝুঁকির পাশাপাশি ১৩টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এর আগে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ২০০টি কর্মশালার মাধ্যমে এসব সুপারিশ নির্ধারণ করা হয়। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এ সেমিনারের আয়োজন করে।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন সভাপতিত্ব সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোর্শেদ, জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএসএম হুমায়ুন কবীর। খসড়া প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন মূল্যায়ন দলের টিম লিডার কাজী ফরহাদ ইকবাল।
আলোচক ছিলেনÑ নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক এম.মাহমুদ আলী, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নুরুল বাশির, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সৈয়দা মাসুমা খাতুন, বুয়েটের অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরিন। এ পর্বে সঞ্চালনা করেন, বেজার নির্বাহী সদস্য সালেহ আহমেদ।
সেমিনারে জানানো হয়, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইতোমধ্যেই ১০৪ উদ্যোক্তাকে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে। কিন্তু এত বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হলে এর সামাজিক, পরিবেশ ও অন্যান্য প্রভাব কী হবে তা নিয়েই মূল্যায়ন করা হচ্ছে। বক্তারা বলেন, পরিবেশকে বাদ দিয়ে উন্নয়নের চিন্তা করা যাবে না। এখানে বায়ু, পানি, শব্দ নিয়ন্ত্রণসহ সব বিষয়কেই গুরুত্ব দিতে হবে। অনেক সময় বড় বড় প্রকল্প করা হলেও তার উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। এ ক্ষেত্রে যেন সেটি না হয়। সরকারি সব সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা সমন্বিতভাবে পরিকল্পিত শিল্পায়নের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করছিÑ যা আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ ও টেকসই উন্নয়ন, কর্মসংস্থান এবং পরিবেশ সুরক্ষার আদর্শ হিসেবে পরিগণিত হবে।’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে কার্যকরী শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সরকারের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়ন সফল হলে বাংলাদেশের বিনিয়োগে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।’
লামিয়া মোরশেদ বলেন, ‘বেজার অধীনে জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হচ্ছেÑ যা এসডিজির বিভিন্ন লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়ন হলে ১১টি এসডিজি গোল বাস্তবায়ন করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এজন্য প্রয়োজন সকলের একসঙ্গে কাজ করা।’
এ এস এম হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘যেকোনো উন্নয়ন পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে, তবে যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে বিপর্যয় রোধ করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নের সময় বায়ু ও পানির গুণমান, জীববৈচিত্র্যের স্থিতিশীলতা এবং আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করলে পরিবেশের ওপর প্রভাব অধিকাংশ হ্রাস করা সম্ভব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরিন বলেন, ‘সমীক্ষার প্রতিবেদনে যে সকল সামাজিক বিষয়ের ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে, তার পাশাপাশি নেতিবাচক প্রভাবকে গুরুত্ব দিয়ে তা সমাধানে এখন থেকে সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
বুয়েটের অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ বলেন, ‘পরিবেশগত অনেক নেতিবাচক প্রভাবের কথা এ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রভাবসমূহ সমাধানে সকলে সমন্বিতভাবে কাজ করলে এই শিল্প শহরকে গ্রিন জোন হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।’ তিনি বলেন, ‘এই সমীক্ষাকে ডায়নামিক ডকুমেন্ট হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে এবং মাস্টার প্ল্যান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তা হালনাগাদ করতে হবে।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সৈয়দা মাছুমা খানম বলেন, ‘বেজা যদি যথাযথভাবে এফ্লুয়েন্ট ও ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণ করে, তাহলে দূষণ অনেকটা কমানো সম্ভব হবে। আগামীতে বেজা ও পরিবেশ অধিদপ্তর সমন্বিতভাবে কাজ করলে জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হয়ে উঠবে দেশের প্রথম কমপ্লায়েন্স জোন।’
নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মাহমুদ আলী জানান, তার অধিদপ্তর ইতোমধ্যে মিরসরাই উপজেলার মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুত করেছে এবং এখন এটির বাস্তবায়ন প্রয়োজন। নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে সকল বিভাগকে তাদের দায়িত্ব অনুযায়ী এগিয়ে আসতে হবে।
এদিকে সেমিনারে জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিবেশ রক্ষায় ১৩টি সুপারিশের কথা বলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ বায়ুদূষণ কমাতে আঞ্চলিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, আঞ্চলিক পর্যবেক্ষণ তথ্য পর্যালোচনার ভিত্তিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে শিল্প নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ বিবেচনা করতে হবে, পানিদূষণ নিয়ন্ত্রণে আঞ্চলিক পানি মান পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, সিএসটিপি এবং সিইটিপির নির্গমনস্থলে পানির মান পর্যবেক্ষণে সমন্বিত পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা স্থাপন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের জন্য ওয়্যারপো থেকে অনুমতি নিতে হবে।
এ ছাড়া বিশেষ করে ল্যান্ডফিল সাইটগুলোর জন্য একটি ভূগর্ভস্থ পানির গুণগত মান পর্যবেক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা উচিত। সকল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অবশ্যই দৃঢভাবে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২১-এর শর্তাবলি অনুসরণ, বিকল্প পানির উৎস হিসেবে এই অঞ্চলে একটি লবণাক্ততা অপসারণকারী প্ল্যান্টকে বিবেচনা করা যেতে পারে। কার্যক্রম শুরু করার আগে একটি পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ শিল্প উন্নয়ন ও প্রভাবিত উন্নয়ন বিবেচনা করে এ অঞ্চলের জন্য একটি ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত এবং ধাপে ধাপে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
বর্তমান সুপার ডাইকের বাইরের অংশে একটি সবুজ বেষ্টনী উন্নয়নের জন্য সুপারিশ করা হচ্ছে- যা সুপার ডাইক এবং এনএসইজেডকে ঘূর্ণিঝড় এবং সংশ্লিষ্ট জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষা দেওয়া হবে। আঞ্চলিক নিষ্কাশন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে এবং বিশেষ করে বর্ষার আগে এই অঞ্চলের নিষ্কাশন ব্যবস্থার কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বন্যা ও জলাবদ্ধতা কমাতে যথাযথ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে এবং পরিবেশগত ও সামাজিক সুরক্ষা নীতিমালা অনুযায়ী ভূমি, জীবিকা, উপার্জন এবং অন্যান্য বিনিয়োগের ক্ষতির জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।