রফিক মোহাম্মদ :
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীমের মালিকানাধীন চট্টগ্রামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পোর্ট সিটি ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এক ছাত্রীকে ‘হত্যা, গুম ও ধর্ষণের’ হুমকি দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণের পরেও অভিযুক্ত ছাত্রকে শাস্তি দিতে গড়িমসি করার অভিযোগ ওঠেছে।
ছাত্রীকে যৌন হয়রানির ঘটনায় ঘটিত তদন্ত কমিটি এবং যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সেলের তদন্তে ওই অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের সুপারিশ করা হলেও কয়েকজন শিক্ষক তাঁকে ‘বাঁচানোর’ চেষ্টা করছেন। এমন পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ভুক্তেভোগী ওই ছাত্রী।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, নিজের বিভাগের জুনিয়র ওই ছাত্রীটিকে এক বছর ধরে নানাভাবে হেনস্তা করে আসছিলেন সুমন বৈদ্য নামের ওই ছাত্রটি। ছাত্রীটি এর প্রতিবাদ করলে উল্টো তাঁকে হত্যা, গুম ও ধর্ষণের হুমকি দিতেন। পরবর্তীতে ছাত্রীটি এই বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানানোর কথা বললে সুমন আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এবার বিভাগ ও বিভিন্ন মিডিয়া হাউস তার পকেটে আছে দাবি করে ওই ছাত্রীটিকে ক্রমাগত হুমকি দিতে থাকেন। এভাবে একের পর এক হুমকি দিতে থাকায় মানসিক যন্ত্রণা ও আতঙ্কে ভুক্তভোগী ছাত্রীটি বেশ কিছুদিন ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়াও বন্ধ করে দেন। তবে জুলাই বিপ্লবের পর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে ওই শিক্ষার্থীকে সহপাঠীরা সাহস জোগালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। এরপর ওই ছাত্রের বিরুদ্ধে আরও কয়েকজন ছাত্রীকে হয়রানির অভিযোগ সামনে আসে।
গত ১৯ আগস্ট ছাত্রীটির করা অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর এস এম ওসমান গনিকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির কাছে সুমন তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো স্বীকার করে নেন এবং তাঁর আচরণের জন্য ক্ষমা চান। এসময় সাময়িক বহিষ্কারাদেশ জারি করে গত ১৯ সেপ্টেম্বর ঐ ছাত্রকে তার অপরাধের প্রেক্ষিতে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রেরণ করা হয়। তবে এবার নিজের বক্তব্য পাল্টে ফেলেন সুমন। বরং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং বিচারব্যবস্থাসহ তদন্ত কমিটির বিরুদ্ধেই প্রশ্ন ছুড়ে দেন এবং ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেন।
এর ভিত্তিতে গত ১৬ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি ওই ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত দেয়। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের প্রায় দুই সপ্তাহ গড়ালেও এখনো ওই ছাত্রের বহিষ্কারাদেশ জারি করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এত বড় অপরাধের পরও এখনো সুমনকে শাস্তির মুখোমুখি না করায় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা কয়েকজন শিক্ষক ওই বহিষ্কারাদেশ আটকানোর চেষ্টা করছেন। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বহিষ্কারের বিষয়টি নোটিশ আকারে প্রকাশ করেনি। আগামী সিন্ডিকেটে তারা ওই ছাত্রের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করার চেষ্টায় আছেন।
বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘ওই ছাত্র শুধু একজন নন, বহু ছাত্রীর জীবন বিষিয়ে তুলেছেন। আর বেছে বেছে সে ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছাত্রীদের হয়রানি-হুমকি দিয়েছেন। তিনি কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এটি করে আসছে। সবকিছু প্রমাণ হওয়ার পর বহিষ্কারের সিদ্ধান্তও হয়েছে। কিন্তু সেটি বাস্তবায়নে বাঁধা দিচ্ছেন কয়েকজন শিক্ষক। একজন অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে এই শিক্ষকেরা মূলত এমন জঘন্য অপরাধকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। দ্রুত ওই শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা না হলে আমরা আন্দোলনে নামবো।’
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান ও সাবেক প্রক্টর এস এম ওসমান গনি বলেন, ‘এটা নিয়ে পরে কি হয়েছে আমার জানা নেই। আর এখন আমি প্রক্টরের দায়িত্বে নেই।’
একই বিষয়ে জানতে তদন্ত কমিটির সদস্য ও সহকারী প্রক্টর তাসলিমা আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ওবায়দুর রহমান মিঠু দাবি করেছেন তাঁরা কোনো গড়িমসি করছেন না। তিনি বলেন, ‘এখানে গড়িমসির কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে তদন্ত কমিটি একটি সুপারিশ জমা দিয়েছে। সেটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলথ, রেসিডেন্স অ্যান্ড ডিসিপ্লিনারি কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হবে। পরে এ বিষয়ে সিন্ডিকেট সভায় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর রাশেদ খান মিলন বলেন, ‘আমি মাত্র যোগাদান করেছি। অনেক বিষয়ে এখনো ওয়াকিবহাল না। সবাই আমাদের শিক্ষার্থী। বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
এক যুগ আগে ২০১২ সালে চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী এলাকায় গড়ে তোলা হয় পোর্ট সিটি ইউনিভার্সিটিটি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম।