বৃহস্পতিবার , ২৩শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মতামত

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাস্তবতা

স্বাধীন সাংবাদিকতার মূলনীতি ঘোষণা করে সুরা হুজরাতের ৬ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,  “হে ঈমানদারগন, কোন মিথ্যাবাদী যদি তোমাদের কাছে কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা ভুলবশত কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে না বস। ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারনে তোমাদের অনুতপ্ত হতে হয়।”

আধুনিক সংবাদপত্রকে সমাজের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংবাদপত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি কেবল তথ্য প্রচারের মাধ্যম নয়, বরং জনগণের মতামত গঠনে এবং শাসন ব্যবস্থাকে জবাবদিহির আওতায় আনতে কার্যকর একটি মাধ্যম। সমাজের চোখ ও কান হিসেবে কাজ করেদ  সংবাদপত্র। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা একটি আদর্শ, যা জনগণের কাছে সত্য ও তথ্য পৌঁছানোর নিশ্চয়তা দেয়। তবে স্বাধীনতার এই ধারণার বিপরীতে যদি সংবাদপত্রের লাগামহীনতা দেখা দেয়, তবে তা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কি সত্যিই পূর্ণাঙ্গ, নাকি এর বাস্তবতা আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে মিল খায় না?

স্বাধীনতার সংজ্ঞা ও প্রয়োজনীয়তা: সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে বোঝানো হয় যে, সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম তাদের কাজ করতে পারবেন কোনো প্রকার চাপ, সেন্সরশিপ বা হুমকির শিকার না হয়ে। এটি এমন একটি পরিবেশ যেখানে সত্য প্রকাশের সুযোগ নিশ্চিত করা হয় এবং জনগণও তাদের মতামত মুক্তভাবে প্রকাশ করতে পারে।

স্বাধীন সংবাদমাধ্যম জনগণের অধিকার রক্ষায় কাজ করে। দুর্নীতি উন্মোচন, ক্ষমতাসীনদের ভুল ধরিয়ে দেওয়া এবং জনস্বার্থ রক্ষার জন্য সংবাদমাধ্যম অপরিহার্য। তাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ।

বাস্তবতার চিত্র: কিন্তু সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বাস্তবতা কি এই আদর্শিক মানদণ্ডে পৌঁছাতে পেরেছে? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্নের উত্তর জটিল। দেশে সাংবিধানিকভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে, কিন্তু এর বাস্তবায়নে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা।

সরকারি নিয়ন্ত্রণ, কর্পোরেট চাপ, রাজনৈতিক প্রভাব, এবং আইনগত সীমাবদ্ধতা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, তথ্যপ্রযুক্তি আইন কিংবা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পথ সংকুচিত করেছে। অনেক সময় সাংবাদিকদের হুমকি দেওয়া হয়, আটক করা হয়, এমনকি হত্যার মতো চরম ঘটনাও ঘটে।

অর্থনৈতিক চাপ ও কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ:

আধুনিক সংবাদপত্রের বাস্তবতায় কর্পোরেট হস্তক্ষেপ একটি বড় সমস্যা। অনেক সংবাদমাধ্যম অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার জন্য কর্পোরেট বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল। এর ফলে বড় কর্পোরেশন বা পৃষ্ঠপোষকরা কখনো কখনো সংবাদের বিষয়বস্তু নির্ধারণে প্রভাব ফেলে।

এছাড়া, সাংবাদিকদের কম বেতন, অনিরাপত্তা এবং পেশাগত ঝুঁকি তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার প্রেরণায় বাধা সৃষ্টি করে। আশা ও সমাধানের পথ: যদিও বাস্তবতায় অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। প্রথমত, সংবিধান প্রদত্ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখতে আইনি কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং সাংবাদিক দমনমূলক অন্যান্য আইন পুনর্বিবেচনা করা জরুরি।

দ্বিতীয়ত, সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য সরকার, গণমাধ্যম মালিক এবং সাংবাদিক ইউনিয়নকে একত্রে কাজ করতে হবে। তৃতীয়ত, সংবাদমাধ্যমকে কর্পোরেট চাপমুক্ত করতে বিকল্প অর্থায়নের ব্যবস্থা বা স্বতন্ত্র ফান্ড গঠন একটি কার্যকরী পদক্ষেপ হতে পারে।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা: গুরুত্ব ও সীমানা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে বোঝায় যে, সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম তাদের কাজ করতে পারবেন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক চাপ থেকে মুক্ত থেকে। এটি গণতন্ত্রের ভিত্তি রক্ষার অন্যতম উপায়। একটি স্বাধীন সংবাদমাধ্যম দুর্নীতি উন্মোচন, জনগণের মতামত প্রকাশ এবং ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

তবে স্বাধীনতার অর্থ কখনোই লাগামহীনতা নয়। স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্ব এবং নৈতিকতা জড়িত। সংবাদপত্রের কাজ হলো সঠিক ও নিরপেক্ষ তথ্য পরিবেশন করা। তথ্য বিকৃতি, অতিরঞ্জন, অথবা কারো সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য সংবাদ প্রকাশ করলে তা স্বাধীনতার অপব্যবহার হিসেবে বিবেচিত হয়।

সংবাদপত্রের লাগামহীনতার কারণ:

সংবাদপত্রের লাগামহীনতা বিভিন্ন কারণে হতে পারে।

১. অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা: বাণিজ্যিক দিক থেকে সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দর্শক বা পাঠক আকৃষ্ট করার জন্য অনেক সময় সংবাদমাধ্যম অতিরঞ্জিত শিরোনাম, ভিত্তিহীন তথ্য বা গুজব প্রকাশ করে।

২. অর্থনৈতিক প্রভাব: কর্পোরেট স্বার্থ এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা অনেক সময় সংবাদমাধ্যমের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করে তোলে। এ ধরনের প্রভাব সংবাদকে নিরপেক্ষ থাকার পরিবর্তে পক্ষপাতদুষ্ট করে তোলে।

৩. তথ্য যাচাইয়ের অভাব: আধুনিক সময়ে দ্রুত সংবাদ প্রচারের চাপে অনেক সময় তথ্য যাচাই ছাড়াই সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এর ফলে ভুল তথ্য জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।

৪. আইনি ও নৈতিক তদারকির অভাব: অনেক দেশে সংবাদমাধ্যমের কার্যক্রম তদারকির জন্য কার্যকর নীতিমালা বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। এর ফলে লাগামহীনতা বাড়তে পারে।

লাগামহীনতার প্রভাব:

সংবাদপত্রের লাগামহীনতা সমাজে গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ক. গুজব ও ভুল তথ্যের বিস্তার:  লাগামহীন সংবাদমাধ্যম ভিত্তিহীন খবর প্রচার করে, যা সমাজে বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।

খ. ব্যক্তিগত সুনামের ক্ষতি: ভুল তথ্য বা অতিরঞ্জিত রিপোর্টিং ব্যক্তির সুনাম ক্ষুণ্ন করতে পারে, যা নৈতিক এবং আইনগত দিক থেকে অনুচিত।

গ. সাংবাদিকতার প্রতি আস্থার অভাব: লাগামহীন সাংবাদিকতা সাধারণ মানুষের মধ্যে সংবাদমাধ্যমের প্রতি আস্থা কমিয়ে দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। সমাধান: স্বাধীনতা ও দায়িত্বের ভারসাম্য:

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং লাগামহীনতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।

১. নৈতিক সাংবাদিকতা চর্চা: সাংবাদিকদের উচিত তথ্য যাচাইয়ের প্রতি মনোযোগ দেওয়া এবং নৈতিক সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনে চলা।

২. প্রভাবমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি: সংবাদমাধ্যমকে কর্পোরেট ও রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত রাখতে আইনি কাঠামো শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

৩. তদারকি সংস্থা গঠন: সংবাদমাধ্যমের কার্যক্রম তদারকির জন্য একটি স্বাধীন সংস্থা গঠন করা যেতে পারে, যা ভুল তথ্য বা লাগামহীন রিপোর্টিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে।

৪. সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ: সাংবাদিকদের দক্ষতা ও পেশাগত দায়িত্বশীলতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা প্রয়োজন।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং দায়িত্ব একটি মুদ্রার দুই পিঠ। স্বাধীনতা ছাড়া সংবাদমাধ্যম সত্যিকারের ভূমিকা পালন করতে পারবে না, আর লাগামহীন স্বাধীনতা তা অকার্যকর করে তুলতে পারে। তাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি এর দায়িত্বশীলতাও নিশ্চিত করতে হবে। ন্যায়পরায়ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ সাংবাদিকতাই একটি সুশৃঙ্খল এবং উন্নত সমাজ গঠনে সহায়ক হতে পারে। এমন নৈতিক স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে অনেক বাধা রয়েছে, তবে সচেতনতা, আইনগত সংস্কার এবং সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত বাস্তবতাগুলোকে আরও উন্নত করতে পারি। সত্য প্রকাশের লড়াই কখনোই সহজ নয়, কিন্তু এটি অব্যাহত রাখতে হবে, কারণ একটি স্বাধীন সংবাদমাধ্যমই প্রকৃত গণতন্ত্রের স্তম্ভ।

লেখক, রাজনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক কাউন্সিলর, চসিক।


সম্পর্কিত খবর