এ পর্যায়ে আমরা ইবাদত আল্লাহ্ তায়ালার নিকট কবুল হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শর্তসমূহের বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। কারণ অনেক চেষ্টা ও কষ্টের ফসল ইবাদত যদি আল্লাহ্ তায়ালার নিকট গ্রহণযোগ্য না হয় তাহলে এর চেয়ে বড় আফসোস ও পরিতাপের বিষয় আর কিছু হতে পারেনা। তাই আমাদের প্রত্যেককেই ভালো করেই জানতে হবে কি কি কারণে ইবাদত বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে সে সম্পর্কে।
{১} নিয়তের বিশুদ্ধতা:
ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিয়তের বিশুদ্ধতা বা সহীহ নিয়ত। নিয়ত বিশুদ্ধ বা সহীহ নাহলে কোন ইবাদতই আল্লাহ্ তায়ালার নিকট গ্রহণযোগ্য বা কবুল হবেনা। বিশুদ্ধ নিয়তের এ গুরুত্বের কারণেই ইমাম বুখারী (রাহ) নিয়ত সংক্রান্ত হাদিস দ্বারা সহীহ বুখারী শুরু করেছেন।
উক্ত হাদিসে রাসূল (সা) এরশাদ করেন-
“আলক্বামাহ ইব্নু ওয়াক্কাস আল-লায়সী (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ আমি ‘উমর ইব্নুল খাত্তাব (রাঃ) কে মিম্বারের উপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছিঃ আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছিঃ কাজ (এর ফলাফল) হবে নিয়ত অনুযায়ী। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে ইহকালিন লাভের জন্য অথবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে- তবে তার হিজরত সে উদ্দেশ্যেই পরিগণিত হবে, যে জন্যে সে হিজরত করেছে।
(৫৪, ২৫২৯, ৩৮৯৮, ৫০৭০, ৬৬৮৯, ৬৯৫৩; মুসলিম ২৩/৪৫ হাঃ ১৯০৭,আহমাদ ১৬৮) সহিহ বুখারী, হাদিস নং-১ হাদিসের মান: সহিহ হাদিস। উপরোক্ত হাদিস থেকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মাণ হলো যে,নিয়ত সহীহ না হলে আমল সহীহ হবেনা। তাই নিয়ত সহীহ নাহলে কোন ইবাদত আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবেনা। তাই সকল ইবাদতের একমাত্র লক্ষ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।মহান আল্লাহ এ কথাটি কুরআনে কারিমের নিম্মোক্ত আয়াতে এরশাদ করেছেন-
“তবে তাদের মধ্য থেকে যারা তাওবা করবে, নিজেদের কর্মনীতি সংশোধন করে নেবে, আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং নিজেদের দ্বীনকে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে নেবে, তারা মুমিনদের সাথে থাকবে। আর আল্লাহ নিশ্চিয়ই মুমিনদেরকে মহাপুরস্কার দান করবেন।” (সুরা: আন-নিসা আয়াত নং :-১৪৬) উল্লেখিত আয়াতে দ্বীনকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ করার” মর্মার্থ কালজয়ী তাফসীর তাফহীমুল কুরআনে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ব্যাখ্যাটি পাঠকদের অবগতির জন্য পেশ করা হলো- (তাফসীর : টিকা:১৭৪)
নিজের দ্বীনকে একান্তভাবে আল্লাহর জন্য করে নেয়ার অর্থ হচ্ছে, মানুষ আল্লাহ ছাড়া আর কারো আনুগত্য করবে না, একমাত্র আল্লাহর প্রতি অনুগত ও বিশ্বস্ত হবে। তার সমস্ত আগ্রহ, আকর্ষণ, প্রীতি-ভালোবাসা, ভক্তি-শ্রদ্ধা একমাত্র আল্লাহর প্রতি নিবেদিত হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোন জিনিসকে যে কোন মুহূর্তে বিসর্জন দিতে কুন্ঠিত হবে এমন ধরণের কোন ভালোবাসা বা হৃদয়ের টান তার কোন জিনিসের প্রতি থাকবে না। ”এছাড়াও কুরআনে কারিমের নিম্মোক্ত আয়াতসমূহে আল্লাহ্ পাক আরো এরশাদ করেন- [হে মুহাম্মাদ! (সা.) ] আমি তোমার কাছে হকসহ এ কিতাব নাযিল করেছি। তাই তুমি একনিষ্ঠভাবে কেবল আল্লাহর ইবাদাত করো। (৩৯ আয-যুমার, আয়াত: ২) কুরআন কারিমের আরেক স্থানে আল্লাহ্ তায়ালা আরো বলেন, (হে নবী!) এদের বলো, আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে, যেন আমি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহরই দাসত্ব করি।” (৩৯ আয-যুমার, আয়াত: ১১)
সূরা আল্ বাইয়্যেনাহতে আল্লাহ পাক আরো এরশাদ করেন, তাদেরকে তো এছাড়া আর কোন হুকুম দেয়া হয়নি যে, তারা নিজেদের দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদাত করবে, নামায কায়েম করবে ও যাকাত দেবে, এটিই যথার্থ সত্য ও সঠিক দ্বীন। (৯৮ আল-বাইয়েনাহ, আয়াত: ৫) হাদিসে কুদসীতে রাসূল (সা:) বলেন, আবূ হুরাইরাহ (রা:) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ হে আদম সন্তান! তুমি পূর্ণ মনযোগসহ ও একনিষ্ঠভাবে আমার ইবাদাতের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা কর, আমি তোমার অন্তরকে ঐশ্বর্যে পূর্ণ করে দিব এবং তোমার অভাব দূর করে দিব। তুমি তা না করলে আমি তোমার দুইহাত কর্মব্যস্ততায় পরিপূর্ণ করে দিব এবং তোমার অভাব-অনটন রহিত করবো না। (সহীহঃ ইবনু মা-জাহ (৪১০৭)। জামে আত-তিরমিজি, হাদিস নং ২৪৬৬ হাদিসের মান: সহিহ হাদিস)
আরেক হাদীসে রাসূল (সা:) এরশাদ করেন, যায়দ বিন সাবেত (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “তিনটি বিষয় এমন আছে, যাতে কোন মুসলিমের হৃদয় খিয়ানত করতে পারে না। (এক) নির্ভেজালভাবে আল্লাহর জন্য আমল করা। (দুই) সাধারণ মুসলিমদের (নেতাদের) জন্য কল্যাণ কামনা করা। (তিন) মুসলিমদের জামাআতকে আঁকড়ে ধরে থাকা। কেননা, তাঁদের (ঐক্যবদ্ধতার) আহবান তাঁদের সকলকে পরিবেষ্টন করে রাখে।”(কিতাবুস সুন্নাহ, শায়বানী ৯৪, ১০৮৫, ১০৮৭, মিশকাত, তাহক্বীক্ব-সহ ২২৮ নং) (হাদিস সম্ভার, হাদিস নং ১৮৫৫ হাদিসের মান: সহিহ হাদিস।)
রাসল (সা:) আরো এরশাদ করেন, যায়েদ বিন ছাবেত (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আমি শুনেছি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ “আল্লাহ তায়ালা উজ্জলতা দান করুন সেই ব্যক্তিকে যে আমাদের একটি হাদীছ শ্রবণ করে অতঃপর তা অপরের কাছে পৌঁছে দেয়। কেননা জ্ঞান বহনকারী কতক ব্যক্তি তার চেয়ে অধিক জ্ঞানীর কাছে পৌছে দেয়। আর জ্ঞান বহনকারী কতক ব্যক্তি, নিজেই জ্ঞানী নয়। তিনটি বিষয়ে কোন মুসলিমের অন্তর হিংসা করে নাঃ (১) আমলকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ করা (২) নেতৃবৃন্দকে নসীহত করা এবং (৩) (মুসলমানদের) জামাআতকে আকড়ে থাকা।
কেননা এদের দু’আ অন্যান্যদেরকেও পরিবেষ্টিত করে। যে ব্যক্তির দুনিয়াটাই হল একক উদ্দেশ্য, আল্লাহ তার প্রতিটি বিষয়কে বিশৃংখল করে দেন। দুচোখের সামনে শুধু অভাব-অনটন লাগিয়ে রাখেন। আর নির্ধারিত বস্তু ছাড়া দুনিয়ার কোন কিছুই তার কাছে আসে না। যে ব্যক্তির উদ্দেশ্য শুধুমাত্র আখেরাত, আল্লাহ তার প্রতিটি বিষয় সুশৃংখল করে দেন। তার অন্তরকে পরিতৃপ্ত করে দেন। আর দুনিয়ার সম্পদ তার সামনে লাঞ্ছিত অবস্থায় হাজির হয়।” (হাদীসটি ইবনু হিব্বান (সহীহ) গ্রন্থে এবং বায়হাকী বাক্যগুলো কিছু আগে পিছে করে বর্ণনা করেন।) (আর আবু দাউদ, তিরমিয়ী, নাসাঈ ও ইবনু মাজাহ হাদীছটির শুরু থেকে নিজেই জ্ঞানী নয়..। পর্যন্ত বর্ণনা করেন।) (সহিহ তারগিব ওয়াত তারহীব, হাদিস নং ৯০ হাদিসের মান: সহিহ হাদিস।) সুপ্রিয় পাঠক উপরোক্ত হাদিসদ্বয় থেকে জানা গেল,কারো আমল যদি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে না হয় তাহলে সে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। একাধারে সে আখেরাতে তার আমলের কোন বিনিময় পাবেনা এবং দুনিয়ায় তার জীবন বিশৃঙ্খলায় ভরে যায় ও অভাব-অনটন লেগে থাকে। তাই সকল প্রকার আমল ও ইবাদত-বন্দেগী যেন কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই হয় সে ব্যাপারে আমাদের অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারন যে কোন আমল আল্লাহর নিকট গ্রহনযোগ্য হওয়ার জন্য নিয়ত সহীহ ও বিশুদ্ধ হওয়া একান্ত অপরিহার্য। (চলবে)