বৃহস্পতিবার , ২৩শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

রাজনীতি

নওফেলের ইসকন কানেকশন

দেশে ২০২৪-এর ডামি নির্বাচনের আগে নগরীর প্রবর্তক মোড়ে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রকাশ্যে নিজেকে ইসকনের সদস্য হিসেবে ঘোষণা দেন পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। বলেন, তার পিতা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী তাকে ভারতের রামকৃষ্ণ মিশনে পড়তে পাঠান। তখন থেকেই তিনি ইসকনে যোগ দেন। এরপর থেকে দেশে-বিদেশে ইসকনের বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন বলেও জানান নওফেল। মূলত ওইদিন থেকেই ইসকনের খুঁটির জোর প্রকাশ পায় চট্টগ্রামবাসীর সামনে।

প্রবর্তক সংঘের জমি ও মন্দির দখল

চট্টগ্রামের হিন্দু সামাজিক জাতীয়তাবাদী ধর্মীয় সংগঠন প্রবর্তক সংঘের নামেই প্রবর্তক এলাকার নামকরণ। একটি পাহাড় ও তার পাদদেশ মিলে ৮ একর ৩৩ শতাংশ আয়তনের বিশাল একটি এলাকা নিয়ে এই প্রবর্তক সংঘ প্রতিষ্ঠিত। পাহাড়ের ওপর ছোট একটি মন্দিরও ছিল সংগঠনটির। ক’বছর আগে একটি মন্দির তৈরির কথা বলে ১৮ গণ্ডা বা ৩৬ শতাংশ জমি ইজারা নেয় ইসকন। কিন্তু জমি বুঝে নেওয়ার পর থেকেই স্বরূপে আবির্ভূত হয় ইসকন। ধীরে ধীরে পাহাড়ের তিন একর জমি দখলে নেয় তারা। প্রবর্তকের ছোট মন্দিরটি ভেঙে শতকোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা হয় বিশাল মন্দির। এর নাম দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দির। বর্তমানে মন্দির ভবনের পাশে বিশাল রেস্টুরেন্ট, বেকারিসহ কাপড়ের দোকান বসিয়ে ব্যবসাও করছে তারা। পাহাড়ের একাংশে ঢাল কেটে তৈরি করা হচ্ছে বিশাল আবাসিক ভবন। পাহাড়ের ওপর নির্মাণাধীন এই ভবনের জন্য সিডিএর কোনো প্লান অনুমোদন নেওয়া হয়নি। পরিবেশ অধিপ্তর থেকেও নেওয়া হয়নি কোনো ছাড়পত্র।

এ বিষয়ে প্রবর্তক সংঘের সভাপতি ইন্দু নন্দন দত্ত জানান, ইসকন তাদের জমি দখল করে প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দির তৈরি করে। প্রবর্তক সংঘের কোনো সদস্য মন্দিরে যেতে চাইলেও তাদের যেতে দেওয়া হয় না। প্রবর্তক সংঘ থেকে মন্দিরে ওঠার জন্য ভেতরের সিঁড়িটি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে ইসকন। মন্দিরের আশপাশে চুক্তিবহির্ভূত জায়গায় তারা অনুপ্রবেশ করেছে। বায়েজিদ বোস্তামী রোড থেকে মন্দিরে ওঠার পথে ভেতরে নিরাপত্তা চৌকিসংলগ্ন একটি শতবর্ষ প্রাচীন গাছ রাতের অন্ধকারে কেটে ফেলা হয়েছে। এতে পাহাড়ের মাটির ক্ষতি হচ্ছে। এই ঘটনায় ইসকনের কয়েকজনকে আসামি করে চট্টগ্রাম আদালতে মামলা করে প্রবর্তক সংঘ। কিন্তু সাবেক মন্ত্রী নওফেল, হাছান মাহমুদ ও আ জ ম নাছিরের প্রভাবে আদালতও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

শেফালী ঘোষের বাড়ি দখলের অভিযোগ

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান মানেই শেফালী ঘোষ। তাকে আঞ্চলিক গানের রানি বলেন কেউ কেউ। কিন্তু চট্টগ্রামের মানুষের সেই আবেগের কণ্ঠস্বরে আঘাত করে বসে উগ্রধর্মীয় সংগঠন ইসকন। ২০২২ সালে নগরের নন্দনকাননে অবস্থিত প্রখ্যাত এ শিল্পীর বাড়িটি দখল করে নেয় সংগঠনটি। শুধু দখল নয়, তার সনদ, পদকও লুটে নিয়ে যায় তারা। নন্দন কানন এলাকার বাসিন্দা অজয় ধর নামে শেফালী ঘোষের এক ভক্ত জানান, শেফালী ঘোষ নেই প্রায় ১৮ বছর। কিন্তু নন্দনকাননের সেই ছোট্ট ঘরে গেলেই টের পাওয়া যেত শিল্পীর সান্নিধ্য। শেওলা পড়া, স্যাঁতসেঁতে ঘরের জীর্ণ দুয়ার খুললেই বেরিয়ে আসত একটা দিগন্ত। বাড়ির দেওয়ালে ঝুলে থাকা নানান পদক, পুরস্কার, খাটে বিছানো তোশক যেন মনে করিয়ে দিত কিংবদন্তি শিল্পীকে। কিন্তু সেখানে এখন কেবলই শূন্যতা।

শেফালী ঘোষের পরিবারের সদস্য এবং স্থানীয়রা জানান, ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেফালী ঘোষ মারা যান। এরপর ধীরে ধীরে তার স্বজনরাও বাড়িটি ছেড়ে কেউ বিদেশে আবার কেউ অন্যত্র চলে যান। এ সুযোগে বাড়িটি দখল করে নেয় ইসকন। ২০২২ সালের ২১ এপ্রিল দুপুরে ইসকনের সমর্থকরা হঠাৎ করে সশস্ত্র অবস্থায় এসে শেফালী ঘোষের ঘর দুটি দখল করে নেয়। ঘরের ভেতর থেকে আসবাবপত্র, শিল্পীর রাষ্ট্রীয় সনদসহ বিভিন্ন উপঢৌকন লুট করে নেন তারা। পড়ে এ ঘটনায়ও শেফালী ঘোষের প্রবাসী সন্তান সুশান্ত দত্ত দেশে এসে কোতোয়ালি থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের হুমকিতে থানা মামলা নিতে সাহস পায়নি। পরে চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ইসকন নেতাদের নামে একটি মামলা করেন তিনি।

বিএনপি নেতা মীর নাছিরের জমি দখল

চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনের জায়গাও দখল করেছে ইসকন। চিন্ময় দাস পরিচালিত পুন্ডরিকধাম মন্দিরের পাশের ১৫ শতক বাউন্ডারি করা একটি প্লটের মালিক মীর নাছিরের প্রয়াত স্ত্রী ডালিয়া নাজনীন নাছির। ২০২৩ সালে হঠাৎ করে প্লটটি নিজেদের দাবি করে বসে ইসকন। ওইদিনই গেরুয়া পোশাক পড়া একদল লোক সীমানা প্রাচীর ভেঙে দখলে নেয় জমিটি।

মীর নাছিরের ছেলে বিএনপি নেতা মীর হেলাল আমার দেশকে জানান, জমিটি ১৯৫১ সালে তাদের এক নিকটাত্মীয় মীর আহমেদ সওদাগর ক্রয় করেন। ১৯৯২ সালে তার কাছ থেকে কিনে নেন মীর হেলালের মা। এরপর থেকে তাদেরই দখলে ছিল জমিটি। কিন্তু হঠাৎ করে জমিটির দাবি করে বসে ইসকন। কোনো অলোচনা না করেই গত সংসদ নির্বাচনের আগে উল্টো মীর নাছিরের নামে জমি দখলের অভিযোগ তুলে উপর্যুপরি মিথ্যাচার, এমনকি চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেন ইসকন নেতা চিন্ময়।

ইসকনের পক্ষালম্বন করে নওফেল মীর নাছিরকে জমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য হুমকি দেন। মীর হেলাল জানান, হাটহাজারীর জমি ইসকনকে ছেড়ে না দিলে তাদের চট্টগ্রামের বাড়ি দখল করে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন সাবেক মন্ত্রী নওফেল।

নওফেলের পলায়নের গোয়েন্দা তথ্য

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী স্বঘোষিত ইসকনের সদস্য হওয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু অপ্রকাশ্যে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা হাছান মাহমুদ, সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনও ইসকনের সদস্য ছিলেন। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহিনী পুরোটাই এখনো ইসকনের হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ওইদিন দুপুরেই বনানীর এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন নওফেল। ওই রাতেই ঢাকার ইসকন সদস্যদের সহায়তায় তাদের গাড়িতে করেই চট্টগ্রামের প্রবর্তক মন্দিরে এসে আশ্রয় নেন নওফেল। এখানে পাঁচদিন লুকিয়ে থাকার পর আনোয়ারার এক আত্মীয়ের বাড়িতে যান তিনি। সেখান থেকে মাছ ধরা ট্রলারে করে গভীর সাগরের হিরন পয়েন্ট এলাকায় যান। এরপর ভারতীয় একটি নৌযান এসে তাকে উদ্ধার করে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের বক্তব্য

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা পরিচালিত এদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো আর আগের মতো কাজ করতে পারছে না। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে হলে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে হবে। ইসকনের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলে ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের বিষয়টিই সামনে আসে। কোনো ধর্মীয় নেতা বিশেষ পরিস্থিতিতে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে মাঠে নামলে সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ আছে। তাই বিতর্কিত এ সংগঠনটি সম্পর্কে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।

ইসকনের বক্তব্য

জমি দখলের সব অভিযোগ অস্বীকার করে ইসকনের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য দ্বিজমনি গৌরাঙ্গ দাস বলেন, হাটহাজারীতে বিএনপি নেতা মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন আরেকজনের কাছ থেকে জমিটি কেনেন। গৌরাঙ্গ দাসের দাবি, মীর নাছির যার কাছ কিনেছেন, তিনিই ভুয়া দলিল তৈরি করে জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। মূলত ওই জমির মালিক ইসকন নিয়ন্ত্রিত পুন্ডরিকধাম মন্দির। এছাড়া শেফালী ঘোষের বাড়িটি তারই পুত্রবধূ দীপা দত্তের কাছ থেকে কেনা। প্রবর্তক সংঘের জায়গাটিও ইসকনের যৌথ মালিকানা রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

(সূত্রঃ আমার দেশ)


সম্পর্কিত খবর