চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ২০১৬ সালে ঢাকায় এসে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতাকে ‘সমন্বিত কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বে’ উন্নীত করেছিলেন। এবার বেইজিংয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) পলিটব্যুরোর সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই জানালেন, চীনের প্রতিবেশী কূটনীতির ‘গুরুত্বপূর্ণ স্থানে’ রাখা হয়েছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের জনগণের জন্য সুপ্রতিবেশীসুলভ ও বন্ধুত্বের নীতি অনুসরণ করে চীন।
অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরের সময় বেইজিংয়ে গতকাল মঙ্গলবার চীনের এমন অবস্থান তুলে ধরেছেন ওয়াং ই। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন দিয়াওউইতাইয়ে অনুষ্ঠিত এ আনুষ্ঠানিক বৈঠকে তৌহিদ হোসেন বলেন, চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল, সরকার ও সমগ্র জনগণের সমর্থনপুষ্ট।
চার দিনের সফরের দ্বিতীয় দিনে তৌহিদ হোসেন সিপিসির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানছাওয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। এতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারপ্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি চীনের অব্যাহত সমর্থনের পাশাপাশি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন লিউ জিয়ানছাও।
সামগ্রিকভাবে তৌহিদ হোসেনের এই চীন সফরে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি সামনে রেখে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে নিবিড় সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে।
গতকাল বিকেলে বেইজিংয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সিপিসির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী ও চীনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থার (সিডকা) চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠকের পর আলাদাভাবে প্রকাশিত দুই দেশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
নদীর পানির উপাত্ত নিয়ে সমঝোতা স্মারক
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ওয়াং ইর বৈঠক ‘ইয়ালুজাংবু-যমুনা নদীর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প-সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদানের বিষয়ে এমওইউর বাস্তবায়ন পরিকল্পনা’ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে আলোচনা শেষ হয়। প্রসঙ্গত, ব্রহ্মপুত্রের উজানে ইয়ালুজাংবু নদীতে একটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে চীন। এ জন্য ইয়ালুজাংবু-যমুনা নদীর তথ্য-উপাত্ত বিনিময়ের ব্যাপারে এই সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
রাজনৈতিক সম্পর্কে গুরুত্ব চীনের
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে বৈঠক করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। গতকাল বেইজিংয়ে দেশটির রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন দিয়াওউইতাইয়েছবি: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সৌজন্যে
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরে ওয়াং ই বলেন, চীন সব সময় বাংলাদেশকে তার প্রতিবেশী কূটনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রেখেছে এবং বাংলাদেশের সব মানুষের জন্য সুপ্রতিবেশী ও বন্ধুত্বের নীতি অনুসরণ করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে বেইজিংকে বেছে নিয়েছেন। এটি চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টার গভীর মনোযোগের প্রতিফলন বলে মন্তব্য করেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। দুই দেশের আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর চীন ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলোচনার খবর প্রকাশ করেছে।
সিপিসির পলিটব্যুরোর সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, চীন ও বাংলাদেশ সুপ্রতিবেশী, যারা একে অন্যকে সহায়তা করে। অভিন্ন উন্নয়নপ্রত্যাশী দুই দেশ ভালো অংশীদার। গত ৫০ বছরে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে উভয় পক্ষই সব সময় একে অন্যকে সম্মান করেছে, একে অপরকে সমকক্ষ বিবেচনা করে আচরণ করেছে এবং উভয়ের জন্য সমান সুযোগের পথ রেখে সহযোগিতা করেছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই দেশ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরে ওয়াং ই বলেন, চীন সব সময় বাংলাদেশকে তার প্রতিবেশী কূটনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রেখেছে এবং বাংলাদেশের সব মানুষের জন্য ‘সুপ্রতিবেশী ও বন্ধুত্বের নীতি’ অনুসরণ করেছে। এ বছর চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি এবং ‘চীন-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বছর, যা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিকাশে নতুন সুযোগ তৈরি করেছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, চীন দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের উন্নয়নে নিঃস্বার্থ সহায়তা দিয়েছে এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য বাস্তবসম্মত সুবিধা নিশ্চিত করেছে। চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে ধারাবাহিকভাবে সরকার ও সমগ্র মানুষের সমর্থনপুষ্ট।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা চীনে তাঁর প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর সম্পর্ককে নতুন গতি দিতে চীনের সঙ্গে একটি শক্তিশালী অংশীদারত্বে যুক্ততার জোরালো অভিপ্রায়ের প্রতিফলন বলে উল্লেখ করেন। তিনি ‘এক চীন নীতি’র প্রতি বাংলাদেশের জোরালো অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
তৌহিদ হোসেন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশে চীনের অর্থায়নে উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে কথা বলেন। আলোচনায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগের প্রসঙ্গটি এসেছে। চীনা মন্ত্রী একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার এবং গণতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ উত্তরণের প্রতি চীনের অব্যাহত সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।
নির্দিষ্ট হাসপাতালে বাংলাদেশিদের জন্য চিকিৎসার সুবিধা
বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার জন্য কুনমিংয়ে তিন থেকে চারটি স্বীকৃত হাসপাতাল বিশেষভাবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য নির্বাচন করার কথা জানান। বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে ঢাকায় বিশেষায়িত চীনা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার বাংলাদেশের প্রস্তাবকেও তিনি স্বাগত জানান। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিক্ষা, রেলওয়ে, কৃষি, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, পশুসম্পদ, মৎস্য, জাহাজভাঙা শিল্প, টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং সুনীল অর্থনীতির মতো খাতে আর্থিক, কারিগরি ও সক্ষমতা বৃদ্ধির সহযোগিতা এবং সহায়তার জন্য বাংলাদেশের অনুরোধ বিবেচনা করার জন্য ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানকে স্বীকৃতি দিয়ে দুই পক্ষ অঞ্চল ও পথের উদ্যোগের (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ—বিআরআই) অধীনে অব্যাহত সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছে। তারা দাশেরকান্দি পয়োনিষ্কাশন প্রকল্প, মোংলা বন্দরের আধুনিকীকরণ, ডিজিটাল সংযুক্তি স্থাপন এবং ফোরজি সম্প্রসারণ নামে প্রস্তাবিত চীনা অর্থায়নে প্রকল্পগুলোতে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
আলোচনায় রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টিও এসেছে। এর একটি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করার জন্য একটি পথনকশার কাজ করতে যৌথ অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের অব্যাহত যোগাযোগের আশ্বাস দিয়েছেন।
ঋণে নানা ছাড়ের অনুরোধ
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন চীনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থার (সিডকা) চেয়ারম্যান লাও ঝাওহুইয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁরা বাংলাদেশে চীনের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্প নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সিডকা চেয়ারম্যানকে ক্রেতার অগ্রাধিকারমূলক ঋণ (পিবিসি) ও সরকারি ছাড়কৃত ঋণ (জিসিএল) সুদের হার ২-৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করার এবং ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ২০ বছর থেকে ৩০ বছর করার বিষয়টি বিবেচনার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি বাংলাদেশে চীনা ঋণের প্রতিশ্রুতি ফি এবং ব্যবস্থাপনা ফি মওকুফ করার অনুরোধ করেন। সিডকা চেয়ারম্যান বলেছেন, তাঁরা ইতিমধ্যে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়েছেন এবং সুদের হার আরও কমানোর বিষয়ে বিবেচনা করবেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সিডকা চেয়ারম্যানকে ছাড়কৃত ঋণ ও অনুদানের পরিমাণ এবং প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ানোর অনুরোধ করেছেন। সিডকা চেয়ারম্যান ইতিবাচক সাড়া দিয়ে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার প্রকল্পের তালিকা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। তাঁরা বাংলাদেশে মেট্রোরেল এবং দক্ষিণাঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (সাউদার্ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ—সিডি) অর্থায়ন নিয়েও আলোচনা করেন।