আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মুফাসসিরে কোরআন ড. মিজানুর রহমান আজহারি বলেছেন, আল্লাহ কোরআনে তিনটি আদেশ ও তিনটি কাজকে নিষেধ করেছেন। আদেশ তিনটি হল ন্যায় বিচার করা, একে অপরকে সম্মান করা ও নিকট আত্মীয়দের দান করা। আর তিনটি নিষেধ হল অশ্লীলতায় না জড়ানো ও ইচ্ছাকৃত মন্দ বা অসৎ কাজে না জড়ানো ও সীমালঙ্ঘন না করা। এই আদেশ নিষেধ মেনে নিতে পারলে আমাদের সমাজ সুখী, সমৃদ্ধ হয়ে গড়ে উঠবে।
শুক্রবার রাতে ঐতিহাসিক প্যারেড ময়দানে (শহীদ রজব আলী ময়দান) ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ চট্টগ্রামের উদ্যোগে আয়োজিত পাঁচদিন ব্যাপী ঐতিহাসিক তাফসিরুল কুরআন মাহফিলের পঞ্চমদিনে প্রধান মুফাসসিরের আলোচনায় তিনি এই কথা জানান।
মাহফিলে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে স্মৃতিচারণ করে মিজানুর রহমান আজহারি বলেন, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে বিনা অপরাধে জেলে বন্দি রেখে মৃত্যুর দিকে ঢেলে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ উনাকে জান্নাতবাসী করুক।
তিনি আরও বলেন, আল্লাহ তা’আলা কোরআনে আত্মীয়দের সাথে উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন এবং এর ফজিলতের কথা উল্লেখ করেছেন। আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদাচরণ করা ও সম্পর্ক বজায় রাখা আমাদের পারিবারিক জীবনের সৌন্দর্য ও স্থায়িত্বের মূল উপাদান। ইসলামে আত্মীয়তার বন্ধনকে মহান মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে, যা পারিবারিক বন্ধনকে শক্তিশালী করে।
ড. মিজানুর রহমান আজহারী বলেন, ন্যায়পরায়ণতা ইসলামী চরিত্রের বিশেষ একটি দিক। ন্যায়পরায়ণতার গুণ ছাড়া কোনো মানুষ প্রকৃত মানুষ হতে পারে না। যে মানুষের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতা নেই, সে মানুষই না। আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে ন্যায়পরায়ণতার গুণে গুণান্বিত করতে হবে নিজেকে। মানুষকে সর্বপ্রথম ইনসাফ বা সুবিচার কায়েম করতে হবে তার ব্যক্তিজীবনে। ব্যক্তিজীবন শুদ্ধ করার পর তাকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মধ্যেও ইনসাফ কায়েম করতে হবে।
ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ চট্টগ্রামের সহ সভাপতি নজরুল ইসলাম ও এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মাওলানা খাইরুল বাশারের সঞ্চালনায় এবং ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ তাহেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সুযোগ্য পুত্র মাওলানা শামীম সাঈদী। বক্তব্য রাখেন মাওলানা বিএম মফিজুর রহমান, মাওলানা মুনিরুল ইসলাম, বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মুজাহিদুল ইসলাম, বিআইএ জামে মসজিদের খতিব সাফওয়ান বিন হারুন আজহারি, অলি খাঁ মসজিদের খতিব মাওলানা মাহমুদুল হাসান, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক তাওহীদুল হক মিজবাহ প্রমুখ। মাহফিলে আখেরি মুনাজাত পরিচালনা করেন মাওলানা সাইয়্যেদ আনোয়ার হোসেন তাহের জাবিরী আল মাদানী।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ধর্মীয় উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম প্যারেড ময়দান বিশ্বনন্দিত মুফাসসিরে কোরআন আল্লামা সাঈদী বিজড়িত ময়দান। আমরা কোরআনের ছায়াতলে এক ও অভিন্ন। যেকোনো ভাবে আমাদের এই ঐক্যকে ধরে রাখতে হবে। মতবিরোধ নিয়েই আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকবো। সব ধরনের ইসলামী দলগুলোর মধ্যে যদি আমরা ঐক্য ধরে রাখতে পারি তাহলে দেশ থেকে দুর্নীতি , লুটপাট ও চাঁদাবাজি, গুম, খুন দূর করতে পারবো। ১৬ বছরের জঞ্জাল ৬ মাসে দূর করা সম্ভব না, কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি সংস্কারের মাধ্যমে একটি সুন্দর বাংলাদেশ উপহার দেওয়ার জন্য।
তিনি আরো বলেন, আমরা আগামীতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করবো। এদেশে ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। দেশে যদি সুখ, শান্তি ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই তাহলে কোরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠার বিকল্প নাই।
ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদের উপদেষ্টা ও সাবেক এমপি আলহাজ্ব শাহজাহান বলেন, অর্ন্তবর্তী সরকার বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের সরকার। আপনারা হতাশ হবেন না। আমরা আপনাদের সাথে আছি। চট্টগ্রামের জনগণও আপনাদের সাথে আছে। তিনি কওমি ও সরকারি নিছাবের আলেমদের ঐক্যবদ্ধ করার আহবান জানান। এছাড়াও তিনি চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের উন্নয়নের সরকারি সহযোগিতার আহবান জানান। ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের দাবি এবং মসজিদের ঈমাম মুয়াজ্জিমদের বেতন কাঠামো নির্ধারন করে সরকারিভাবে বেতন প্রদানের জন্য জোর দাবি জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মাওলানা শামীম সাঈদী বলেন, আল্লামা দেলোওয়ার হোসেন সাঈদীকে ১৩ বছর জেলে জালেম শাসকেরা শান্তিতে থাকতে দেয়নি। তারা পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করেছে। আমরা সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করছি। কোরআনের রাজ কায়েম করার জন্য আল্লামা সাঈদী দেশের আনাচে কানাচে দাওয়াত দিয়ে গিয়েছেন। কোরআনের রাজ কায়েম করতে যদি আমাদের মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয় আমরা সেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবো।
বিশেষ ওয়ায়েজিন মাওলানা বিএম মফিজুর রহমান আজহারি বলেন, এ পৃথিবীতে যারা কোরআনকে বিদায় করতে চেয়েছে তারাই বিতাড়িত হয়ে গেছে। আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রাস্তায় কাজ করে যেতে হবে। পরস্পর বিভেদ সৃষ্টি করা যাবে না। অনৈক মতভেদ, বিভেদ সৃষ্টি করলে জালেমরা সুযোগ নিবে। আল্লাহ আমাদেরকে একটি নির্দিষ্ট এসাইন্টমেন্ট দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহর বিধানকে দুনিয়ার জমিনে প্রতিষ্ঠা করতে হলে সমস্ত মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারলে বাংলাদেশে কোনো অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। কেউ যেন অন্যায়ভাবে লুটপাট করতে না পারে। নির্যাতনের আয়নাঘর তৈরি করতে না পারে। শোষণ নিপীড়ন করতে না পারে, গণহত্যা করতে না পারে সে জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মুজাহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমরা প্রথমত আল্লাহর বান্দা এবং আল্লাহর খলিফা। আমাদেরকে ভেতরে ও বাহিরে পবিত্র নেক বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করো। আর যারা জালেম তাদের লেজ কেটে দিয়েছে এবং এখন বান্দার দায়িত্ব আল্লাহর প্রশংসা করা।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক তাওহীদুল হক মিজবাহ বলেন, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে রক্ত পিন্ড থেকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা মানব ও জিন জাতিকে আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। নবী রাসূলগণকে জমিনের মধ্যে দ্বীন কায়েমের জন্য আল্লাহ তায়ালা প্রেরণ করেছেন। আর আমাদেরকে নবী রাসুলগণের ওয়ারিশ বানিয়েছেন। আমাদেরকেও আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের প্রচেষ্টা করতে হবে।
বিশিষ্ট ওয়ায়েজ সাফওয়ান বিন হারুন আজহারি বলেন, আমরা ধর্ম ব্যবসা করি না। ধর্মীয় অনুশাসনের ভিত্তিতে রাজনীতি করি। ইসলামকে ছাড়া রাষ্ট্র বাঁচতে পারে না। আর রাষ্ট্রকে ছাড়া ইসলাম বাঁচতে পারে না। তাই রাজনীতি আর ইসলাম সমান্তরাল।
বিশিষ্ট ওয়ায়েজিন মাওলানা মাহমুদুল হাসান বলেন, ইসলাম বিরোধী শক্তি রাসুলকে (স.) বিভিন্নভাবে দ্বীনের দাওয়াত না দেওয়া জন্য বাঁধা দিয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর রাসুল (স.) শত বাঁধা, যুদ্ধ পেরিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। ইসলামের কোন একটা আইনকে অস্বীকার করলে ঈমান থাকে না। আল্লাহর সকল বিধানের সাথে একনিষ্ঠভাবে ঐক্যমত পোষণের নাম হলো ঈমান।
মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাবেক এমপি মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও তাফসিরুল কোরআন মাহফিলের এন্তেজামিয়া কমিটির পৃষ্ঠপোষক মাওলানা মুহাম্মদ শাহজাহান, সাবেক এমপি ও তাফসিরুল কোরআন মাহফিলের এন্তেজামিয়া কমিটির পৃষ্ঠপোষক আলহাজ্ব শাহজাহান চৌধুরী, আইআইউসির সাবেক প্রো ভিসি ড. প্রফেসর আবু বকর রফিক আহমদ, এডভোকেট শামসুদ্দিন আহমেদ মির্জা, আবুল হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার মোমিনুল হক, মাওলানা হারুনুর রশিদ, ডা. এ কে এম ফজলুল হক, অধ্যাপক নুরুল আমিন চৌধুরী, ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ, অধ্যক্ষ মুহাম্মদ নুরুল আমিন, মাওলান এ বি এম সিদ্দিকুল্লাহ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর গিয়াস উদ্দিন তালুকদার, আনোয়ারুল আলম চৌধুরী, অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল মোমেন, অধ্যাপক আব্দুল আলিম, আলাউদ্দিন সিকদার, অধ্যক্ষ বদরুল হক, অধ্যক্ষ আ ন ম সলিমুল্লাহ, আলহাজ্ব আফছার উদ্দিন চৌধুরী, প্রফেসর ড. শামীম উদ্দিন, প্রফেসর মাহবুবুর রহমান, ড. প্রসেফর আতহার উদ্দিন, সাংবাদিক মুহাম্মদ উল্লাহ, ফয়সল মুহাম্মদ ইউনুস, মোরশেদুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর অধ্যক্ষ শামসুজ্জামান হেলালী, মাওলানা মমতাজুর রহমান, অধ্যক্ষ মাওলানা জাকের হোসাইন, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, সেলিম উল্লাহ জামান, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুস শাকুর ও মাওলানা মাহমুদুল হক, ছাত্রনেতা শহীদুল ইসলাম, আলাউদ্দিন আবির, ডা. সাদেক আব্দুল্লাহ, তানভীর হোসেন জুয়েল, মুহাম্মদ ইব্রাহিম হোসেন রনি, মুহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল, আমিরুল ইসলাম তুহিন, শওকত আলী, আব্দুর রহিম প্রমুখ।
তাফসীরুল কোরআন মাহফিলের সভাপতি ও ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ তাহের পাঁচদিন ব্যাপী মাহফিল সফল করায় দেশবাসী (মা ও বোনসহ) সকলকে মোবারকবাদ জানান। মাহফিলে দায়িত্ব পালনকারী স্বেচ্ছাসেবক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সাংবাদিকগণ ও সমাজ কল্যাণের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান এবং তিনি সকলের ত্যাগ ও কোরবানিকে কবুল করার জন্য আল্লাহ নিকট তৌফিক কামনা করেন।
মাহফিলে ইসলামী সংগীত পরিবেশন করেন পাঞ্জেরি ও চট্টলা শিল্পীগোষ্ঠী। মাহফিলে শহীদ আল্লামা সাঈদী স্বরণে কবিতা পাঠ করেন কবি সুলতান আহমদ।