বৃহস্পতিবার , ২৩শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মতামত

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (PR) নির্বাচন পদ্ধতি

ভূমিকা

দু’সহস্র শাহাদাত, শত শত জনের অঙ্গহানি, অন্ধত্ব, হাজার হাজার পরিবারের নির্যাতন-নিপিড়নের শিকারে পরিণত হওয়ার পর অবশেষে বিগত ৩৬ জুলাই (৫ আগষ্ট ২০২৪) ম্যান্ডেটবিহিন ফ্যাসিবাদী শাসন বিদায় নিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে আগষ্টের ৮ তারিখে এবং সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানকে টেকসই করে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে মৌলিক সংস্কারের পর সম্ভাব্য কম সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে অনেকটা জাতীয় ঐক্যমত্য তৈরি হয়েছে। অক্টোবরের শুরুতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সংস্কারের রূপরেখা ঘোষণা করেছে যেখানে
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (Proportional Representation) নির্বাচন পদ্ধতিও প্রস্তাব করা হয়েছে। উক্ত পদ্ধতির বিষয়ে তাড়াতাড়ি নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার বিএনপি ছাড়া অন্যান্য প্রায় সকল দল পজিটিভলি সাড়া দিয়েছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। দলীয় ক্যাডার ও কালো টাকার প্রভাব মুক্ত শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষ্যে পিআর পদ্ধতিতে আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।

তাছাড়া, এ পদ্ধতিতে ছোট-বড় বেশি সংখ্যক দলের শীর্ষ নেতাদের সংসদে আসার সুযোগ সৃষ্টি হলে মেধাবী নেতৃত্বের সম্মিলন হবে আশা করা যায়। তবে বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে যে, পতিত স্বৈরাচারের খুনিসহ
অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার আগে তাদেরকে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সুযোগ দেয়া যাবে না। এমনকি ভিন্ন ব্যানারেও তারা যাতে নির্বাচনে আপাতত আসতে না পারে সে বিষয়ে গণপ্রতিরোধ সৃষ্টি করতে হবে। নিম্নে পিআর (PR) পদ্ধতির নির্বাচনের স্বরূপ বিশ্লেষন করা হলো।

প্রার্থী নয় দলকে ভোট দেয়া

এ পদ্ধতিতে ভোটাররা কোনো প্রার্থীকে ভোট দেয় না, রাজনৈতিক দলকে ভোট দেয়। প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলসমূহের নাম ও প্রতিকসহ ব্যালট ছাপানো হয়। ভোটারগণ প্রতিকের উপর সীল মারবেন। PR পদ্ধতি ডেনমার্ক, সুইডেন, ইতালি, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ইত্যাদি রাষ্ট্রে চালু আছে।
প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হারে আসন সংখ্যা নির্ধারণ: নির্বাচনে যে কয়টি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তারা প্রদত্ত ভোটের মোট সংখ্যার শতকরা যত ভোট যে দল পায় পার্লামেন্টের আসন সংখ্যার শতকরা ততভাগ আসনে ঐ দল বিজয়ী বলে গণ্য হয়। ধরুন, বাংলাদেশে মোট ভোটার ১২ কোটি; সারাদেশে ভোট কাস্ট হলো ৯ কোটি অর্থাৎ কাস্টিং রেট ৭৫℅। নির্বাচনে ক,খ,গ,ঘ এবং ঙ এই ৫ টি দল প্রতিদ্বন্ধিতা করে যথাক্রমে ক দল ৪৫℅ (৪.০৫কোটি), খ দল ২৫℅ (২.২৫ কোটি), গ দল ১৫ % (১.৩৫ কোটি), ঘ দল ১০℅ (০.৯ কোটি) এবং ঙ দল ৫℅ (০.৪৫ কোটি) ভোট পেলো।
বাংলাদেশের পার্লামেন্টে মোট ৩০০ আসন হিসেবে দল ভিত্তিক আসন সংখ্যা দাঁড়াবে: (ক) দল = ১৩৫ টি,(খ) দল = ৭৫ টি, (গ) দল = ৪৫ টি, (ঘ) দল = ৩০ টি,(ঙ) দল = ১৫ টি

ছোট-বড় বেশি সংখ্যক দলের শীর্ষ নেতাদের সংসদে আসার সুযোগ সৃষ্টি হলে মেধাবী নেতৃত্বের সম্মিলন হবে আশা করা যায়।
তবে বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে যে, পতিত স্বৈরাচারের খুনিসহ অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার আগে তাদেরকে
নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সুযোগ দেয়া যাবে না। এমনকি ভিন্ন ব্যানারেও তারা যাতে নির্বাচনে আপাতত আসতে না পারে সে বিষয়ে
গণপ্রতিরোধ সৃষ্টি করতে হবে।

দলীয় তালিকা থেকে সংসদ সদস্য বাছাই

নির্বাচনের পূর্বেই প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বী দল জাতীয় সংসদে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার উপযুক্ত ব্যক্তিদের তালিকা নির্বাচন কমিশনের নিকট জমা দিবে। প্রদত্ত তালিকায় দলীয় বিবেচনায় ব্যক্তিদের নাম যোগ্যতার মানের ক্রম অনুযায়ী সাজানো থাকবে। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হবার পর প্রাপ্ত মোট ভোটার সংখ্যার অনুপাতে যে দল যে কয়টি আসনের অধিকারী হয়, নির্বাচন কমিশন দলীয় তালিকার প্রথম থেকে শুরু করে ঐ সংখ্যক ব্যক্তিকে নির্বাচিত ঘোষণা করবে।

ভোট প্রাপ্তির সর্বনিম্ন হার

কোনো দল নির্দিষ্ট সংখ্যার ভোটের কম পেলে ঐ সংসদে উক্ত দলের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকবে না। যেমন : তুরস্কে মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ১০ ভাগের কম ভোট পেলে কোনো দলের প্রতিনিধিত্ব পার্লামেন্টে থাকে না। এরকম বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশে করা হলেও দল সংসদে কোন আসন পাবে না। সেক্ষেত্রে ১৫ সিট আনুপাতিক হারে বাকী ৪ টি দলের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। তবে, বাংলাদেশে এরূপ বাধ্যবাধকতা না থাকাই ভালো মনে করছি; যাতে সংসদে ছোট বড় প্রতিটি দলের প্রতিনিধিত্বসহ মেধাবী নেতৃত্বের সম্মিলন ঘটে। প্রচলিত ধারণার পরিবর্তন জরুরি:
প্রচলিত নিয়মে একটি সংসদীয় আসনে এক জন করে প্রতিনিধি নির্বাচিত হন এবং ‍তিনি ঐ অঞ্চলের জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সেবা করেন। চজ পদ্ধতিতে এটা হবে না। সংসদ সদস্যদের কাজ হলো আইন প্রণয়ন করা। সমাজসেবা করার জন্য উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হয় এবং লোকাল প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। সংসদ সদস্যগণ কোনো এলাকার প্রতিনিধি হবেন না; বরং তারা সারা দেশের জনগণের প্রতিনিধি। অবশ্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহযোগিতার জন্য তাদেরকে একটি করে সংসদীয় এলাকার দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।

নোট: অধ্যাপক গোলাম আযম রচিত
জাতীয় সংসদে রাজনৈতিক দলের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতি বই অনুসরণে লিখিত।
লেখক: পরিবেশবিদ ও দৈনিক কর্ণফুলির উপদেষ্টা


সম্পর্কিত খবর