বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের নগরী হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার। পর্যটন নগরী হিসেবে যেমন পরিচিত তেমনি শুঁটকির জন্যও বিখ্যাত এ শহর। প্রতি মৌসুমে কোটি কোটি টাকার শুঁটকি উৎপাদন হয় এ জেলায়। তবে চলতি মাসের টানা বর্ষণে বড় ধাক্কা খেয়েছে শুকটব ব্যবসায়ীরা। প্রায় দুই কোটি টাকার মাছ পানির নিচে চলে যাওয়ায় উৎপাদন বন্ধ ছিল প্রায় ৬ দিন।
৬ বন্ধ থাকার পর মঙ্গলবার থেকে আবারো শুরু হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ শুটকি পল্লীতে শুরু হয়েছে উৎপাদন। পুরোদমে চালু হতে আরও কিছু সময় লাগবে জানিয়ে ব্যবসায়ীরা বলেন- আগে শুধু শীত মৌসুমেই শুটকি উৎপাদন হতো৷ এখন তা বাড়িয়ে পুরো বছর শুটকি উৎপাদন করে এখানকার ব্যবসায়ীরা। তবে বৃষ্টির কারণে অনেক সময় তা বড় লোকসানেরমূখে পড়ে। তারই ধারাবাহিকতায় গেল বুধবার থেকে টানা রেকর্ড বর্ষণে বড় লোকসানে পড়ে এখানকার ব্যবসায়ীরা। কক্সবাজারের নাজিরারটেক, ফদনারডেইল, নুনিয়াছড়া, মহেশখালী, সোনাদিয়া, কুতুবদিয়াতে শুরু হয়েছে শুঁটকি উৎপাদন।
জেলার কয়েকটি শুঁটকি মহাল ঘুরে দেখা যায়, নাজিরারটেক সাগরের পাশে বিশেষ উপায়ে তৈরি বাশেঁর মাচার ওপর প্রায় ২০/২৫ প্রজাতির কাঁচা মাছ বিছিয়ে সূর্যের তাপে শুকিয়ে তৈরি করা হচ্ছে শুঁটকি। এরমধ্যে ছুরি, কোরাল, মাইট্যা, ফাইস্যা, লইট্ট্যা, পোপা, রূপচাঁদা, টেকচাঁদা অন্যতম। এ সব কাঁচা মাছ শুঁটকি হতে সময় লাগে ৪ হতে ৫ দিন। বড় মাছের ক্ষেত্রে সময় লাগে ১২ থেকে ১৫ দিন।
খুচরা বাজারে প্রতি কেজি শুটকি লইট্যা ৫৫০-৬০০ টাকা, ফাইস্যা ৪০০-৬০০ টাকা, ছুরি ৬০০-১২০০টাকা, চিংড়ি ১৪০০- ২০০০ টাকা, ছোট পোয়া ৪৫০-৮০০ টাকা, রূপচাঁদা ১৮০০-৩০০০ টাকা, লাক্ষা ২৮০০-৩২০০ টাকা, মাইট্যা ১৪০০-২০০০ টাকা, কালা চান্দা ১২০০-১৫০০টাকা, বাইম মাছ ৬০০-১০০০ টাকা, বাইলা ৫০০-৮০০ টাকা, বাশপতি(পেউয়া) ৬০০- ৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়।
ইতোমধ্যে প্রায় সকল শুঁটকি মহালে বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী আবু সাঈদ। তিনি বলেন, ‘শুঁটকি মহালগুলোতে প্রতি মৌসুমে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক কাজ করে। প্রতি দিন ৩০০ থেকে ৪০০ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু টানা বৃষ্টির কারণে বড় ধাক্কা খেয়েছে এবার। তা কাটিয়ে উঠতে সরকারের সহায়তা প্রয়োজন।
অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর শুটকি উৎপাদন কম হবে বলে দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ এবং বৈরী আবহাওয়া ও সরকার পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে এ শিল্পে। যে কারণে থেমে থেমে বন্ধ হয়েছে আশানুরূপ শুঁটকি উৎপাদন হচ্ছে না।
আরেক শুঁটকি ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন জানান, শুঁটকিতে কোন প্রকার লবণ, বিষ ও বিভিন্ন প্রকার কীটনাশক ব্যবহার না করে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে শুঁটকি উৎপাদন করছে তারা। এর ফলে কক্সবাজারের শুঁটকির হারানো সুনাম ফিরে পাবে বলে আশা করেন তিনি।
কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আতিক উল্লাহ জানান, প্রায় ১০০ একর এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা দেশের বৃহত্তম এ শুঁটকি মহালে ছোট বড় প্রায় অর্ধশতাধিক আড়ত রয়েছে। এখানে নারী সহ প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তবে বৃষ্টির কারণে মাছ তলীয়ে যাওয়ায় প্রায় দুই কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। যা কাটিয়ে উঠতে পুরোদমে শুটকি উৎপাদনে যেতে মরিয়া ব্যবসায়ীরা।
শুঁটকিপল্লির শ্রমিক ছকিনা বেগম বলেন, ‘সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সওদাগরদের (মালিক) নির্দেশনা মেনে কাজ করি। দৈনিক ৩৫০ টাকা বেতন দেয়। আয়ের চেয়ে খরচ বেশি। এই টাকায় সংসার চলে না। তবু পেটের দায়ে কাজ করি।
মরজিনা আক্তার নামে আরেক শ্রমিক বলেন, ‘সাগর থেকে আহরণকৃত মাছ বেছে পৃথক করি। তারপর রোদে শুকাই। এভাবেই দিন যাচ্ছে। আমার তিন সন্তান রয়েছে। দুজন স্কুলে পড়ে, খরচ নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে আছি। এজন্য কয়েক বছর ধরে এই কাজ করছি।
শ্রমিক মোহাম্মদ আরাফাত বলেন, ‘সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত কাজ করি। ৩০০ টাকা মজুরি দেয়। যারা কাজ বেশি জানে তারা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত পায়। অধিকাংশ শ্রমিক ৩০০ টাকাই পায়।
নুরুল কাদের বলেন, ‘শহরের বাইরে থেকে এসে কাজ করছি। ভাড়া বাসা নিয়ে থাকি। ৪০০ টাকায় খরচ পোষায় না। তবু কাজ না পেয়ে এখানে পড়ে আছি।
শুঁটকি উৎপাদন নিয়ে কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান বলেন, ‘দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে কক্সবাজারের শুঁটকি। বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদনে মহাল মালিক ও ব্যবসায়ীদের ওপর বিশেষ নজর রাখা হয়েছে। নতুন বিধিমালা পাস হলে শুটকি পল্লীকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হবে।