রফিক মোহাম্মদ:
চট্টগ্রাম আদালতের সামনে আইনজীবী এডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যাকান্ড এখনও টক অব দ্যা কান্ট্রি। সাইফুলের হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে উত্তাল বন্দরনগরীসহ সারাদেশ। এরমধ্যে ওই দিন পুলিশের অবহেলার পাশাপাশি উঠে এসেছে বহিষ্কৃত ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর সমর্থক আইনজীবীদের অপেশাদারমূলক আচরণ।আদলাতকে জিম্মি করে চিম্ময়কে জামিন নিতে ব্যর্থ হওয়ার পর অস্ত্রধারী বহিরাগত সন্ত্রাসীদেরকে আদালতে ভাংচুর চালাতে উস্কানি দিয়েছেন তারা।এদের কয়েকজন আবার ভাংচুরেও অংশ নিয়েছেন।সর্বশেষ তাদের প্রকাশ্য উস্কানিতেই অস্ত্রধারীরা এডভোকেট সাইফুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করেছে।এরমধ্যে সাইফুল হত্যাকান্ডের ঘটনায় তার বাবার দায়েরকৃত মামলায় চিম্ময় ও তার সহযোগী আইনজীবীদের নাম উল্লেখ না থাকায় তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
জানা যায়, বহিষ্কৃত ইসকন নেতা চিম্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী ছিলেন এডভোকেট তপন দাশ ও অভিজিত ঘোষ । তবে শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন ২০-২৫ জন আইনজীবী ।এদের মধ্যে কয়েকজন আইনজীবী অপেশাদার আচরণ করেছিলেন। এদের মধ্যে কেউ জয় শ্রীরামসহ বিভিন্ন উসকানিমূলক শ্লোগান দিয়েছেন,কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘাতে জড়িয়েছেন। এমনকি আসামী চিম্ময় কৃষ্ণকে পা ধরে বসে থাকতে দেখা যায় কয়েকজনকে।অস্ত্রধারী ইসকন কর্মীদেরকে এজলাসের ভেতরে যেতেও সহযোগিতা করেন তারা ।
সাইফুল হত্যাকান্ডের সময় আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত থাকা এক আইনজীবী নাম প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘ওইদিন আমাদের কয়েকজন সহকর্মীর অপেশাদার আচরণের কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে।তারা তাদের পেশাদারিত্ব ভুলে গিয়ে সম্পূর্ণ সন্ত্রাসী রুপে এসেছিলেন।মূলত তারাই বাইরে থেকে অস্ত্রধারীদেরকে এনে আদালতকে জিম্মি করে ফেলেন।তারা হ্যান্ডমাইক এনে একজন রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধীকে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ করে দেন।
প্রত্যক্ষদর্শী আরেক আইনজীবী বলেন,’আদালতের শুরু থেকেই এই আইনজীবীরা সেখানে খুব বাড়াবাড়ি করতে থাকেন।তাদের দাবি এখনই জামিন দিতে হবে, এক ঘন্টার মধ্যে দিতে হবে।তখন সিএমএম আদালত অনেকটা বাধ্য হয়ে এক ঘন্টার মধ্যে আদেশ দেন।তখন তারা বিচারককেও প্রকাশ্যে গালিগালাজ করতে থাকেন।এরমধ্যে তারা বিশেষ কায়দায় সেই রায়ের কপি নিয়ে মহানগর দায়রা জজ আদালতে যান।সেখানে গিয়ে বলেন, এখনই জামিন শুনানি করেন।এখনই জামিন দেন।না হলে আপনাকে এজলাস থেকে নামতে দিবো না।তারা বাইরে থেকে আসা সন্ত্রাসীদেরকে নিয়ে বিচারককে অনেকটা রুমের মধ্যে বন্দি করে ফেলেন।সেসময় পুলিশও নির্বিকার ছিলো।একপর্যায়ে বিচারক জামিন না দেয়ায় তারা আদালতে ভাংচুর শুরু করেন।অনেক যানবাহন ভাংচুর করেন।’
এই আইনজীবী বলেন, ‘ইসকনের সশস্ত্র ক্যাডারদের পাশাপাশি এই আইনজীবীরাও সরাসরি ভাংচুরে অংশ নিয়েছেন।একপর্যায়ে পুলিশ এই সন্ত্রাসীদেরকে লাঠিচার্জ করেন।তখন তারা ভাংচুর করতে করতে গেইট দিয়ে বের হয়ে সামনের রঙ্গম সিনেমার পাশ দিয়ে চলে যান।
আর সেসময় ওই সন্ত্রাসীদের সাথে চিম্ময়ের কয়েকজন আইনজীবীও দৌড়ে পালিয়েছিলো।যতটুকু জেনেছি, তাদের মধ্যে একজন সেসময় রঙ্গম সিনেমার সামনে থেকে সাইফুলকে এই সন্ত্রাসীদেরকে দেখিয়ে দেন।তখন কয়েকজন সন্ত্রাসী সাইফুল ইসলামকে টেনে ভেতরে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন।’
আদালত সূত্রে জানা যায়, ২৭ নভেম্বর এডভোকেট সাইফুল হত্যাকান্ডের দিন আদালতে বিশৃঙ্খলাকারী আইনজীবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন এডভোকেট রিগ্যান আচার্জী, এডভোকেট শুভাশীষ শর্মা,এডভোকেট রুবেল পাল, এডভোকেট পার্থ প্রতিম নন্দী, এডভোকেট অজয় ধর,এডভোকেট উজ্জ্বল সরকার, এডভোকেট শ্যামল চৌধুরী, এডভোকেট রুবেল কুমার দেব, এডভোকেট বিক্রম মিত্র। সেদিন উচ্ছৃঙ্খল আচরণকারীদের মধ্যে আরও রয়েছেন এডভোকেট জয় দাশ, এডভোকেট তপন কুমার দাশ, এডভোকেট অন্তু মহাজন, এডভোকেট বিহি চক্রবর্তী, এডভোকেট অর্ণব তালুকদার, এডভোকেট মিথুন বিশ্বাস। এদের মধ্যে শুভাশিষ শর্মা,রিগ্যান আচার্জি সেদিন হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।
জানা যায়, অভিযু্ক্ত এই আইনজীবীদের প্রায় সবাই বঙ্গবন্ধু আওয়ামী পরিষদের সদস্য । এদের মধ্যে অভিজিৎ ঘোষ এইবার চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী পরিষদের প্যানেল থেকে আইটি সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তারা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। এরমধ্যে আন্দোলনের পক্ষে মিছিল করায় গত ৪ আগস্ট রিগ্যান আচার্জি এবং উপেলচন্দ্র নাথের নেতৃত্ব আদালত চত্বরে দুইজন আইনজীবীর মাথা ফাটিয়ে দেয়া হয় । ভুক্তভোগী এই দুই আইনজীবী হলেন এডভোকেট নজরুল ইসলাম ও এডভোকেট শরীফ । এদের মধ্যে এডভোকেট শরীফ দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
এদিকে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, সাইফুল হত্যাকান্ডে উল্লেখিত আইনজীবীদের পাশাপাশি আদালতের কিছু কর্মচারীও জড়িত ছিলেন।এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন আদালতের ক্লার্ক সমিতির সেক্রেটারি রিপন কান্তি নাথ।মূলত তার নেতৃত্বে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু কর্মচারী সেদিন বহিরাগত সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিয়েছিলো।তাদের অনেকে অনেকে সরাসরি হামলায় জড়িত ছিলেন।যে কারণে সাইফুলের জানাযা শেষে আইনজীবীরা ক্লার্ক সমিতির কার্যালয়ে আগুন দেন।
এদিকে নিহত আলিফের বাবার দায়ের করা হত্যা মামলায় ওই আইনজীবী ও চিম্ময়ের নাম নেই।আর এই ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আলিফের সহকর্মী আইনজীবীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আইনজীবি বলেন,’একেবারে মিডিয়ার সামনেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।চিম্ময়ের আইনজীবীরা প্রকাশ্যে ওই হত্যাকাণ্ডে উস্কানি দিয়েছে।তারা বাইরে থেকে সশস্ত্র জঙ্গীদেরকে আদালতে এনে জড়ো করিয়েছিলেন।আরা চিম্ময় হ্যান্ড মাইকে দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে বলে সমর্থকদেরকে উস্কানি দিয়েছেন।আর চিম্ময়ের আইনজীবীরাও সংঘর্ষে জড়িয়েছিলেন।কিন্তু এই হত্যা মামলায় তাদেরকে আসামী করা হয়নি।সেটা আসলেই রহস্যজনক।
জানা যায়,রবিবার (১ ডিসেম্বর) দুপুরে আদালত প্রাঙ্গণে নিহত এডভোকেট সাইফুল ইসলামের জন্য শোকর্যালি করেছেন তাঁর সহকর্মীরা। সেখানে তারা আলিফ হত্যার সাথে জড়িতদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।একইসাথে তারা মামলায় বহিস্কৃত ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীসহ উস্কানিদাতা আইনজীবীদের নামে মামলা না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
শোক র্যালিতে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট নাজিম উদ্দিন বলেন,’ সন্ত্রাসী চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে গত ২৬ নভেম্বর এই কোর্ট বিল্ডিংয়ে পর্যায়ক্রমে যে ঘটনাগুলো হয়েছে এবং অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফকে হত্যার পর যে মামলাগুলো করা হয়েছে প্রতিটি মামলায় চিন্ময় দাসকে আসামি করতে হবে। গতকাল যে মামলা হয়েছে আমরা মনে করি সমস্ত মামলায় চিন্ময় দাসকে এক নম্বর আসামি করতে হবে। আমরা আইনজীবীরা মানবো না যদি চিন্ময় দাসকে এক নম্বর আসামি করা না হয়।’
এদিকে সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকান্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত মোট পাঁচটি মামলায় মোট ৩৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।এদের মধ্যে ৬ জনকে আলিফের বাবার দায়ের করা হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।তবে সর্বশেষ ২৪ ঘন্টায় কাউকে আটক করা যায়নি।